আল্লাহ তো মুত্তাকিনদের কোরবানিই কবুল করেন

আল্লাহর দরবারে কোরবানির গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তাকওয়া

সুজন হাসান | প্রকাশিত: ১১ জুন ২০২৪, ১৮:৪৫

ছবি: সংগৃহীত

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত এক ইবাদতের নাম কোরবানি। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি। (সূরা হাজ্ব; আয়াত-৩৪)’

এরপর অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করল এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন জবেহ করার জন্য। আমি তাকে (ইসমাইল) মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে। (সুরা সাফফাত, আয়াত-১০৩ ও ১০৭)'

পিতা-পুত্রের এ আত্মত্যাগ আল্লাহর দরবারে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যে, আল্লাহতায়ালা পরবর্তী সব উম্মতের মধ্যে তা স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখলেন। কুরআনে বলা হয়েছে- আর আমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে ইব্রাহিমের (আ.) এই সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। (সুরা সাফ্ফাত, আয়াত-১০৮)।

কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে, মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করা। তাইতো জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন- "মনের পশুরে করো জবাই-পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই"। কিন্তু এ কাজটি করি আমরা কয়জন? সবাই তো পশু জবাইয়ে ব্যস্ত। এতে কোরবানির যে মূল উদ্দেশ্য তা থেকে সরে যাচ্ছি আমরা।

মহিমান্বিত এই ইবাদতটি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম শর্তই হচ্ছে তাকওয়া বা একনিষ্ঠতা। যার বর্ণনা পবিত্র কালামে এসেছে এভাবে - "আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন তা হচ্ছে এই যে, যখন তারা দুজনে কোরবানি পেশ করল তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো, অন্যজনের কোরবানি কবুল হল না"। তখন সে তার ভাইকে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বললো, আল্লাহ তো মুত্তাকিনদের কোরবানিই কবুল করেন (সূরা মায়িদা, আয়াত-২৭ ও ২৮)।’

কোরবানি গ্রহণ হওয়ার মূল উপাদান তাকওয়া বা খোদাভিরুতা। কুরআনে এরশাদ করেছেন- "আল্লাহর দরবারে কোরবানির গোশত ও রক্ত কোনো কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া" (সূরা হজ, আয়াত-৩৭)।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাছির (র.) তার গ্রন্থে একটি সহিহ হাদিসের বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন- "আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের দৈহিক রূপের দিকে দেখেন না এবং তোমাদের দিকেও তাকান না বরং দৃষ্টি থাকে তোমাদের অন্তরের ওপর ও আমলের ওপর"।

আমাদের সমাজে অনেকেই আছি, যারা মোটা তাজা পশু কিনি লোক দেখানোর জন্য। বুক ফুলিয়ে, গর্ব করে, সেই কোরবানির পশুর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে থাকি পুলকিত মনে। অনেকে তো মেসি, রোনালদো, নেইমার, জায়েদ খান, রাজাবাবু, সম্রাট, তাহেরী, মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি নামের মোটা-তাজা গরু কেনাকে নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যম বলে মনে করি। এ ধরনের ছোট একটি মনোভাবই কোরবানি বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।

এই কোরবানি যে, ইবাদত নয় তা বলাই বাহুল্য। এরশাদ হচ্ছে, "যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে (সুরা কাহফ, আয়াত-১১০)।"

‘গরুটা কিনে জিতেছি বা গরুটা কিনে ঠকেছি। গরুর দাম এত, মাংস হয়েছে এত কেজি। বড় গরু কোরবানি না দিলে ইজ্জত বাঁচবে না। সমাজে কতক কোরবানিদাতা আছি আমরা, যারা গল্পের ছলে এ জাতীয় কথা বলে থাকি। এ ধরনের অহেতুক কথা কোরবানির যথাযথ উদ্দেশ্যকে নষ্ট করে। কেননা কোরবানি আল্লাহর জন্য, যা লাভ-ক্ষতি, হিসাব-নিকাশ সব কিছুর ঊর্ধ্বে।

ঈদের দিন গরিব-দুঃখী দরজায় কড়া নাড়ে সামান্য একটু গোশতের জন্য। পশুর চামড়া বা চামড়া বিক্রির সামান্য টাকার জন্য। এ ক্ষেত্রে অনেক কোরবানিদাতাকে দেখা যায়, তাদের সঙ্গে রূক্ষ আচরণ করে। কেউ কেউ আবার তাদের রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের গর্হিত কাজ প্রভুর দরবারে কোরবানির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। এরশাদ হচ্ছে, "এবং প্রার্থীকে ধমক দিবেন না" (সূরা আদ্ দুহা, আয়াত-১০)।

কোরবানির মাংস ও চামড়া বিক্রির অর্থ বিতরণে ইসলামের মূল আর্দশ হচ্ছে, কোরবানিদাতা তার মাংস ও অর্থ গরিব দুঃখী ও অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে।

কিছু কোরবানিদাতা রয়েছেন, যারা হাসিলের টাকা এড়ানোর জন্য বিভিন্ন কুটকৌশলের আশ্রয় নেই। যেমন, হাটে পড়শির গরু কিনে, না কিনার ভান করে বাড়ি এসে টাকা পরিশোধ করেন। তাদের এ ধরনের কুটকৌশলে কোরবানি নষ্ট হয়ে যায়।

কোরবানির প্রতিটি পর্বে চাই তাকওয়ারপূর্ণ প্রতিফলন। পশু কেনা থেকে জবাই করা ও চামড়া বিক্রি করা, পশুর বর্জ অপসারণ আমাদেরই কর্তব্য। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে সর্বোচ্চ মূল্য নিশ্চিত করা প্রভুর পক্ষ থেকে গরিব দুঃখীর আমানত। যার যথাযথ প্রাপ্তি নিশ্চিত, সংরক্ষণ ও প্রকৃত হকদারের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রত্যেক কোরবানিদাতার একান্ত কর্তব্য। এরশাদ হচ্ছে- "আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার প্রকৃত হকদারের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে"। (সূরা নিসা, আয়াত-৫৮)।

সমাজের কিছু বিত্তশালী, পেশিশক্তির মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা ঈদুল আজহা এলেই নিজেদের হীনস্বার্থে সিন্ডিকেট তৈরি করে চামড়ার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। স্বল্পমূল্যে ক্রয় তিনগুণ মূল্যে বিক্রি করে নিজেদের পকেট ভারী করেন। এটি অসহায়দের হক নষ্টের অন্যতম কারণ। এরশাদ হচ্ছে- "কেয়ামত দিবসে প্রত্যেক হকদারের হক আদায় করে দেয়া হবে, এমনকি শিংবিশিষ্ট ছাগল শিংবিহীন ছাগলকে মেরে থাকলে ওর প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়ে দেয়া হবে।" (মুসলিম)

অনেক কোরবানিদাতা আছেন, যারা পশুর বর্জ্য ঠিকভাবে পরিষ্কার করেন না। এ কারণে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, ফলে পরিবেশ দূষণের মতো ইসলামের আর্দশ বিবর্জিত কর্মটি সংগঠিত হয়। মানুষ কষ্ট পায়, খোদা অখুশি হন। হাদিসে এরশাদ হচ্ছে- "প্রকৃত মুসলিম তো ওই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ তথা কর্ম ও কথায় অপর মুসলমান কষ্ট পায় না"। আল্লাহ আমাদের কোরবানি বিষয়ক কাজগুলো তাকওয়া ও একনিষ্ঠভাবে করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)

 

লেখক পরিচয়:

এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব

প্রতিষ্ঠাতা - কুমিল্লা জিলা মাদরাসা




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top