এপিজে আবদুল কালাম
আমায় গড়েছেন যারা, তাদের ভুলি কি করে?
রাজিউর রাহমান | প্রকাশিত: ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০৬:২৬
আমি যখন সেন্ট জোসেফে বিএসসি ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হই, উচ্চশিক্ষার জন্য অন্য কোনো বিকল্প সম্পর্কে আমার কিছুমাত্র জানা ছিল না। বিজ্ঞানের একজন ছাত্রের জন্য ক্যারিয়ারের সুযোগ সম্পর্কে আমার কাছে কোনো তথ্যমাত্রও ছিল না। বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করার পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, পদার্থবিজ্ঞান আমার বিষয় নয়। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাকে প্রকৌশল বিষয়ে পড়তে হবে। অথচ ইন্টারমিডিয়েট কোর্স শেষ করে অনেক আগেই প্রকৌশল কোর্সে যোগ দিতে পারতাম। ভর্তির জন্য আবেদন করলাম মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি), এই বিদ্যাপীঠ সেই সময়ে দক্ষিণ ভারতে কারিগরি শিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠান বলে বিবেচিত ছিল।
যখন ফল বেরোল, দেখলাম নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকায় আমার নাম আছে। কিন্তু এই মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া ব্যয়বহুল ব্যাপার। প্রায় হাজার রুপির মামলা। আমার বাবার পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা কঠিন ছিল। আমার বোন জোহরা তার সোনার চুড়ি ও চেন বন্ধক রেখে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে শিক্ষিত দেখার জন্য তার দৃঢ় সংকল্প ও আমার ক্ষমতার প্রতি তার বিশ্বাস আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিল। আমি আমার নিজের উপার্জন দিয়ে তার চুড়ি বন্ধকমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সেই সময়ে আমার কাছে অর্থ উপার্জনের একমাত্র উপায় ছিল কঠোর অধ্যয়ন করা ও বৃত্তি পাওয়া। আমি পুরোদমে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করলাম।
এমআইটিতে কী আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল, জানেন? ফ্লাইং মেশিনের বিভিন্ন সাবসিস্টেম প্রদর্শনের জন্য সেখানে প্রদর্শিত অবসরে যাওয়া দুটি বিমানের দৃশ্য। আমি তাদের প্রতি এক আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। অন্য ছাত্ররা হোস্টেলে ফিরে যেত, কিন্তু এরও অনেক সময় পর পর্যন্ত আমি বিমান দুটোর কাছে বসে থাকতাম। বসে বসে ভাবতাম, পাখির মতো আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে যাওয়ার মানুষের ইচ্ছার কথা। এমন ইচ্ছার তারিফ না করে পারা যায়! প্রথম বছর শেষ করার পর, যখন আমাকে একটি নির্দিষ্ট শাখা বেছে নিতে হয়েছিল, আমি প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিমান প্রকৌশলবিদ্যা (অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) বেছে নিয়েছিলাম।
এবার জীবনের লক্ষ্য যেন স্থির: আমি বিমান ওড়াতে চলেছি। আমার দৃঢ়তার অভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা সত্ত্বেও আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম। আগে থেকে আমি নম্র মনের মানুষ ছিলাম, অতটা শক্ত ছিলাম। কিন্তু এবার আমি বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করলাম। বাধা-বিপত্তি ছিল, হতাশা ছিল, বিক্ষিপ্ততা ছিল। কিন্তু বাবার অনুপ্রেরণামূলক কথাগুলো ওই অস্থির স্রোতে নাও বাইতে আমাকে সাহায্য করেছিল।
বাবার ওই কথাটা আজও কানে ভাসে : যে অন্যকে জানে সে নিঃসন্দেহে জ্ঞানী। কিন্তু সেই প্রজ্ঞান,যে নিজেকে জানে। এমআইটিতে পড়ার সময়, তিনজন শিক্ষক আমার চিন্তাভাবনাকে রূপ দিয়েছিল। তাদের সম্মিলিত অবদান এমন একটি ভিত্তি তৈরি করেছিল যার ওপর আমি পরে আমার পেশাজীবন গড়ে তুলেছিলাম। তারা হলেন: অধ্যাপক স্পনডার, অধ্যাপক কেএভি পান্ডালাই ও অধ্যাপক নরসিংহ রাও। তাদের প্রত্যেকেরই খুব স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ছিল। কিন্তু তিনজনের মধ্যেই একটি মিল ছিল: অনন্য প্রতিভা ও অক্লান্ত উদ্যমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষুধা মেটানোর ক্ষমতা।
অধ্যাপক স্পনডারের কাছে শিখেছিলাম প্রায়োগিক অ্যারোডাইনামিকস। আমাদের সামনে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রহস্য তুলে ধরেছিলেন অধ্যাপক কেএভি পান্ডালাই। অধ্যাপক নরসিংহ রাও একজন গণিতবিদ ছিলেন, যিনি আমাদের তাত্ত্বিক অ্যারোডাইনামিকস শিখিয়েছিলেন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে এই তিন শিক্ষকই পণ্ডিতজন ছিলেন। তারা আমাকে সমন্বিত জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছিলেন।
এমআইটিতে আমার তৃতীয় ও শেষ বছরটি ছিল পরিবর্তনের বছর যার বহুধা প্রভাব ছিল আমার পরবর্তী জীবনে। সেই দিনগুলোয় দেশজুড়ে রাজনৈতিক জাগরণ ও শিল্প প্রচেষ্টার নতুন আবহাওয়া বিরাজ করছিল। যে মূল্যবোধ ব্যবস্থায় আমি বেড়ে উঠেছিলাম, তা ছিল গভীরভাবে ধর্মীয়। আমাকে শেখানো হয়েছিল, বস্তুজগতের বাইরে যে আধ্যাত্মিক জগৎ রয়েছে ওটাই প্রকৃত বাস্তবতা। আমাকে শেখানো হয়েছিল, কেবল আপন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা যায়।
যখন কোর্সের পাঠ শেষ হলো, তখন আমাকে অন্য চার সহপাঠীর সঙ্গে বানাতে বলা হলো একটি প্রকল্প: কম উচ্চতায় ওড়া যুদ্ধবিমানের নকশা বানাতে হবে। আমি অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন প্রস্তুত ও আঁকার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আমার সতীর্থরা বিমান চালনা, গঠন, নিয়ন্ত্রণ ও যন্ত্রের নকশা তৈরির কাজগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। আমার ডিজাইন শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক শ্রীনিবাসন। তিনি তখন এমআইটির পরিচালক।
একদিন তিনি আমার অগ্রগতি পর্যালোচনা করলেন। সব দেখেশুনে বললেন, আমার অগ্রগতি খুব হতাশাজনক। কেন আমি এত পিছিয়ে পড়েছি, শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য এক মাস সময় চাইলাম। অধ্যাপক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখ যুবক, আজ শুক্রবার। আমি তোমাকে তিন দিন সময় দিচ্ছি। যদি সোমবার সকালের মধ্যে আমি কনফিগারেশন অঙ্কন না পাই, তোমার বৃত্তি বন্ধ হয়ে যাবে বলে দিলাম কিন্তু।
ওই বৃত্তিই তো আমার পড়াশোনার মূল জ্বালানি ছিল। বৃত্তি যদি সত্যি বন্ধ হয়ে যায়, আমি তো অসহায় হয়ে যাব। সুতরাং যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সে মতেই কাজটি শেষ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর দেখলাম না। সেই রাতের কথা মনে পড়ে। রাতের খাবার পর্যন্ত খাইনি। বসে পড়লাম অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন আঁকতে। পরের দিন সকালে, ফ্রেশ হওয়া ও খাওয়ার জন্য মাত্র এক ঘণ্টা বিরতি নিয়েছিলাম। রবিবার সকাল নাগাদ আমি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আমি ঘরে অন্য কারও উপস্থিতি অনুভব করলাম।
অধ্যাপক শ্রীনিবাসন দূর থেকে আমাকে দেখছিলেন। দেখেই বোঝা যায়, জিমখানা থেকে সোজা এসে পড়েছেন, তখনো তার পরনে টেনিস পোশাক। আমার অগ্রগতি দেখতে এসেছিলেন। আমার কাজ নিরীক্ষা করার পর অধ্যাপক শ্রীনিবাসন আমাকে স্নেহের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। প্রশংসা করে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, আমি জানতাম, আমি তোমাকে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছি, তোমাকে অসম্ভব এক সময়সীমা বেঁধে দিয়ে কাজ করতে বলেছি। জানো তো, তুমি এত ভালো করবে, আমি সত্যি ভাবতে পারিনি।
এমআইটির আমার সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্মৃতির কথা বলি। স্মৃতিটি অধ্যাপক স্পনডারকে ঘিরে। বিদায় অনুষ্ঠানে গ্রুপ ছবির জন্য আমরা পোজ দিচ্ছিলাম। অধ্যাপকরা সামনের সরিতে বসা ছিলেন। তাদের পেছনে তিন সারিতে স্নাতক শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো। হঠাৎ অধ্যাপক স্পনডার উঠে আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি তৃতীয় সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এসো, আমার সঙ্গে সামনে বসো, বললেন তিনি।
আমি অধ্যাপক স্পনডারের এ আমন্ত্রণে সত্যি বিস্মিত হয়েছিলাম। স্যার বললেন, তুমি আমার সেরা ছাত্র। কঠোর অধ্যবসয়ের ফল তুমি পাবে। তোমার কারণে ভবিষ্যতে তোমার গুরুজনরাও সুনাম কুড়াবেন। এমন প্রশংসায় কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়েছিলাম। কিন্তু স্বীকৃতি পেয়ে সম্মানিতবোধ করেছি। অন্তর্মুখী এই আমি মনে মনে বলেছিলাম, ঈশ্বর তোমার আশা পূরণ করুন, তোমার বেঁচে থাকার রসদ জোগাক, তোমার পথপ্রদর্শক হোক, ভবিষ্যতের অভিমুখে তোমার যাত্রাপথে আলো হয়ে সঙ্গ দিন।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।