দাউদ ইব্রাহিম
কনস্টেবলের ছেলে থেকে যেভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৯ জানুয়ারী ২০২৩, ০৮:৩৭
পুলিশের কনস্টেবলের এক ছেলে থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হয়েছেন দাউদ ইব্রাহিম। ভারতের অপরাধ জগতের সবথেকে বড় ডন এই দাউদ ইব্রাহিমের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের মুম্বাই পুলিশের এক কনস্টেবল ছিলেন ইব্রাহিম কাস্কর। ডোঙ্গরি-নাগপাডা এলাকায় কর্তব্যরত কাস্করকে সকলেই শ্রদ্ধা করত। ইব্রাহিম আর আমিনা কাস্করের ১২ টি সন্তানের অন্যতম দাউদ। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেন দাউদ। ছোটখাটো চুরি ছিনতাই করতেন প্রথমে। তারপরে শুরু হয় পকেটমারি, পাড়ার বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে মারপিট এসব।
ভারতের অপরাধ জগতের সবথেকে বড় ডন দাউদ ইব্রাহিমের শুরুটা হয়েছিল এইভাবেই। ২০ বছর বয়সে ওই ছেলে ছোকরাদের সঙ্গে নিয়েই তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেন সেই সময়ের প্রতাপশালী পাঠান গ্যাংকে। নিজের দলে অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গেই ছিল দাউদের ভাই শাব্বিরও। পরে সংবাদমাধ্যম যে গোষ্ঠীকে ডি কোম্পানি নামে অভিহিত করতে থাকে। মনে করা হয় এখন দাউদের আরেক ভাই আনিস ইব্রাহিম এখন ওই ডি কোম্পানির সব কাজকর্ম দেখাশোনা করেন।
দাউদের প্রথম বড় অপরাধ ছিল ভাই শাব্বির আর তার দলের অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে একটা ব্যাঙ্ক লুঠের ঘটনা। মুম্বাইয়ের কার্ণক বন্দর এলাকার ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির পরেই শহরের সংবাদমাধ্যমের নজরে যেমন তিনি আসেন, তেমনই তার দিকে নজর পরে অন্য গ্যাংগুলিরও। দাউদ মনে করেছিলেন সেই সময়ের 'ডন' হাজি মাস্তানের অর্থ ছিল ওই ব্যাঙ্কে। কিন্তু আসলে এক দশকের মধ্যে সবথেকে বড় ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে লুঠ হওয়া অর্থ ছিল মেট্রোপলিটন কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের। ছেলের কীর্তি শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম কাস্কর।
আরও পড়তে পারেন>>>ডায়ানার মৃত্যুতে মাত্র একবার কেঁদেছিলেন প্রিন্স হ্যারি
মুম্বাইয়ের সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার হুসেইন জাইদি এই ঘটনাটার কথা উল্লেখ করেছেন দাউদকে নিয়ে লেখা তার বই 'ডোংরি টু দুবাই'তে। ইব্রাহিমের একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক ছিল। তাদের মাধ্যমেই তিনি তার দুই ছেলের খোঁজ নিতে শুরু করলেন, জাইদি লিখেছেন তার বইতে।
বেশ কয়েকদিন পরে ইব্রাহিম কাস্কর জানতে পারলেন যে তার দুই ছেলেই বাইকুল্লা এলাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে আছে। বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন দুজনকেই। জাইদি তারপরের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে, মা আমিনা যখন দাউদ আর শাব্বিরকে চিৎকার করে বকাবকি করছেন, তাদের বাবা ইব্রাহিম পাশের ঘরে গিয়ে একটা স্টিলের আলমারি থেকে বার করে আনলেন পুলিশ ইউনিফর্মের মোটা চামড়ার বেল্টটা।
মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চের হেড কনস্টেবল হিসাবে যে বেল্ট গর্বের সঙ্গে তিনি কোমরে বাঁধতেন, সেটা দিয়ে শুরু হল মার। এক নাগাড়ে দুই ছেলের পিঠে পড়ছিল ওই বেল্টের মার। তাদের দুজনের পুরো পিঠে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল।
পরিবারের অন্যরা এসে ইব্রাহিম কাস্করকে জাপটে ধরে তার হাত থেকে বেল্টটা নিয়ে নেন। তার আগে পর্যন্ত মার চলেছিল, লিখেছেন হুসেইন জাইদি। বেল্টটা নিয়ে নেওয়া হলেও দাউদ আর শাব্বিরের বাবাকে থামানো যায়নি। মা আমিনা ছেলেদের জল আর কিছু খাবার দেওয়ার আগেই কাস্কর দুই ছেলেকে টানতে টানতে একটা ট্যাক্সিতে ওঠান। ট্যাক্সিটা সোজা গিয়ে থামে মুম্বাই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ দপ্তরে।
হুসেইন জাইদি লিখেছেন, দুই ছেলেকে নিয়ে সোজা অফিসারদের সামনে হাজির হন ইব্রাহিম কাস্কর। ছেলেদের কীর্তির জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চান ওই হেড কনস্টেবল। তখন তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল। বাবার সততা দেখে দয়া হয় অফিসারদের। তারা দুজনকেই ছেড়ে দেন। এই ঘটনাই সম্ভবত জন্ম দিয়েছিল পরবর্তীকালের ডন দাউদ ইব্রাহিমের।
মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতে দাউদ ইব্রাহিমের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত অন্ধকার জগতের বাদশাদের সঙ্গে তার লড়াই শুরু হয়ে যায়। পাঠান গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রথমে হত্যা করে দাউদের ভাই শাব্বিরকে। সেই গোষ্ঠীর অন্যতম কারিল লালার ভাইপো সামাদ খানকে খুন করে দাউদ তার বদলা নেন। সেটা ১৯৮৬র ঘটনা। এরপরেই দাউদ ইব্রাহিম ভারত ছাড়েন। দুবাই থেকে শুরু হয় 'ডি কোম্পানি'র কাজকর্ম। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে মুম্বাইতে দাঙ্গা শুরু হয়। বহু মুসলমান সেই দাঙ্গায় নিহত হন।
এই ঘটনা দাউদ ইব্রাহিমকে খুবই বিচলিত করেছিল বলে মনে করা হয়। মুম্বাইয়ের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া তার আত্মজীবনী 'লেট মি সে ইট নাও'তে লিখেছেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে মুম্বাইয়ের মুসলমানরা দাউদকে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথমে কিছু করেননি। এরপরে বেশ কয়েকজন মুসলমান নারী দাউদের কাছে চুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপরেই দাউদ ইব্রাহিম মুম্বাই সিরিয়াল বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেন বলে মনে করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহায়তায় তিনি চোরাপথে ভারতে বিস্ফোরক নিয়ে আসেন, আর তা দিয়েই ১২ মার্চ, ১৯৯৩ সিরিয়াল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সেদিন একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৫৭ জনকে হত্যা আর ৭০০ জন আহত হওয়ার সেই ঘটনার মূল চক্রী ছিলেন দাউদ ইব্রাহিমই, এমনটাই অভিযোগ। ওই বিস্ফোরণে দাউদকে সহায়তা করেছিলেন তার গ্যাংয়েরই ছোটা শাকিল, টাইগার মেমন, ইয়াকুব মেমন আর আবু সালেম। ওই বিস্ফোরণে জড়িত থাকার অপরাধে আবু সালেমের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে আর ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির আদেশ হয়।
আল কায়দা আর লস্কর-এ-তৈয়েবার সঙ্গেও দাউদ ইব্রাহিমের যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে যে ৯/১১ এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার ঘটনাতেও দাউদের যোগ ছিল। তাকে একজন 'গ্লোবাল টেররিস্ট' আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা দাউদের সব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।