যুদ্ধের শেষ কোথায়?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১ বছর আজ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০৪:৫৮

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১ বছর আজ

দ্বিতীয় বছরে গড়ালো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে ইউক্রেনও।

যুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই দেশ হারিয়েছে লাখো সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম। লড়াই দুই দেশের মধ্যে থাকেনি, ইউক্রেনের হয়ে পরোক্ষভাবে সংঘাতে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের মিত্র দেশগুলো। মস্কোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে দেশটির বহু মানুষের প্রাণ গেছে। দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন কয়েক লাখ মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ভবনের পর ভবন।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর হিসাব মতে, ইউক্রেনের ৪০ হাজার বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। সম্ভবত ইউক্রেনের ১ লাখ সৈন্য হতাহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১ কোটি ১৪ লাখ ইউক্রেনিয়ান।

জাতিসংঘ বলছে, যুদ্ধে ইউক্রেনে ২১ হাজার বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ৮ হাজার। যুদ্ধ শুরুর পর ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে। সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ পোল্যান্ডে। এছাড়া রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশে শরণার্থী হিসেবে জায়গায় হয়েছে ইউক্রেনীয়দের। অন্যদিকে, যুদ্ধে রাশিয়ার দেড় লক্ষাধিক সেনা নিহতসহ দুই লাখ হতাহত হয়েছে বলে দাবি পশ্চিমাদের।

যুদ্ধের শেষ কোথায়?

এক বছর আগে ভাবা হয়েছিল যুদ্ধটা বেশি দিন স্থায়ী হবে না। রাশিয়া সহজেই জয় পাবে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে।

যুদ্ধের বার্ষিকী উপলক্ষে ইউক্রেনে হঠাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফর ও রাশিয়ার জয়ী না হওয়ার হুঁশিয়ারি, রাশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসা, রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা এবং রাশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদের মন্তব্য বিশ্বকে টালমাটাল পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। এই যুদ্ধ বিশ্বে বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যা এর আগের কোনো যুদ্ধে দেখা যায়নি।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে এই সংঘাত সহসাই থামছে না। জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ নিকোলে মিত্রোখিন বলেন, মৌলিক দৃশ্যকল্প হচ্ছে রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই এই যুদ্ধে তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। ইউক্রেনের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস অঞ্চল পুরোপুরি রাশিয়া দখল করতে পারবে না বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ। নিকোলে আরও বলেন, 'এই যুদ্ধ ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালে থামতে পারে কেননা দুইপক্ষরেই যুদ্ধের যোগান ফুরিয়ে যাবে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশই যা অর্জন করতে চায় তার জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সার্ভিসম্যান নেই।

কিংস কলেজ লন্ডনের রুশ রাজনীতির অধ্যাপক গুলনাজ শারাফুতদিনোভা বলেন, 'আগ্রাসন শুরুর দিকের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ ও রুশ সামরিক বাহিনী পিছু হটলেও যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের অবস্থান এখনও অবিচল।' এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে আশঙ্কা এই প্রফেসরের।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক পাভেল লুজিন বলেন, মূল দৃশ্যপট একই-যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি। রাশিয়া শরত্কালে আগ্রাসনের প্রথম গুরুতর ধাপ শুরু করে এখন দ্বিতীয়টি করছে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার যুদ্ধের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়নি; তারা ইউক্রেনকে ধ্বংস করছে।

রুশ সাংবাদিক ফরিদা রুস্তমোভা বলেন, আমাদের সূত্রগুলো যা বলে তার উপর ভিত্তি করে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি অসম্ভব। পুতিনের অবস্থান আগের মতোই স্থিতিশীল। তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা- যা তিনি রাশিয়ায় তার ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যবহার করেন, একটুও পরিবর্তন হয়নি। এই মুহূর্তে ক্ষমতায় তার দখলে ফাটল ধরতে পারে এমন কোনো গুরুতর বিরোধী দল নেই।

বিশ্নেষকরা মনে করেন, বিচ্ছিন্ন রাশিয়া ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া এখন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ইউক্রেনের সাহসিকতা এবং অনমনীয়তা দেখে বিশ্ব অনুপ্রাণিত। সংক্ষেপে বললে, রাশিয়া এরই মধ্যে কৌশলে হেরেছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, কোণঠাসা রুশ নেতার টিকে থাকার জন্য একটি সামরিক বিজয় দরকার। সেটা দৃশ্যত এখন অসম্ভব হলেও তিনি নির্মমভাবে এবং যে কোনো মূল্যে জয়ী হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে।


যুদ্ধে সারাবিশ্বের ক্ষয়ক্ষতি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনেরই ক্ষতি করেনি, পুরো বিশ্বের মানুষকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে যুক্ত করেছে। যুদ্ধটা ইউরোপের হলেও প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায়। যুদ্ধের কারণে সার্বিকভাবে গত বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি (১.৬ ট্রিলিয়ন) ডলারের।

এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে, ইউক্রেন পুনর্নির্মাণে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, শেষ পর্যন্ত এই ক্ষতি এর বহু গুণ হবে। শুধু বাজেট ঘাটতি মেটাতেই দেশটির গত বছরের শেষ নাগাদ ৩৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশটির বাজেট ঘাটতি মেটাতে ১৮ বিলিয়ন ডলার এবং ওয়াশিংটন আরও ১০ বিলিয়ন ডলার তহবিলের সিংহভাগ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বর্হিবিশ্বে যে প্রভাব ফেলেছে-

জ্বালানি সংকট

রাশিয়া এবং ইউক্রেন এমন দুটি দেশ যারা বিশ্বের খাবার এবং জ্বালানির অনেকটাই সরবরাহ করে। সেই দেশ দুটিই সংঘাতে জড়িয়েছে। এর আগে ইরাক, আফগানিস্তানে আমেরিকা হামলা চালালেও বিশ্বে এতটা প্রভাব পড়েনি। এমনকি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধও বিশ্বকে আর্থিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তেমন একটা নাড়া দেয়নি। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্য ও জ্বালানির দাম এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যে, সাধারণ মানুষকে জীবন রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। হামলার প্রথম দিনেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ১০০ ডলারে পৌঁছে যায়। উন্নত এবং উন্নয়নশীলসহ গোটা বিশ্বেই খাবার ও জ্বালানির দাম উচ্চহারে বাড়িয়েছে। জ্বালানিতে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে ইউরোপকে। কারণ ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। রাশিয়া জার্মানিসহ তার অনেক প্রতিবেশীকে জ্বালানির জন্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপাদানের জন্য চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নির্ভরতা ভবিষ্যতে ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন। কারণ বিশ্বে সোলার প্যানেলের ৭০ শতাংশ উৎপাদন করে চীন। ফলে মোজাম্বিক এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো লাভবান হতে শুরু করেছে।

প্রেসিডেন্ট পুতিন গ্যাস এবং তেলকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এতে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জ্বালানির দাম বাড়িয়ে রাশিয়া কিছু দিনের জন্য লাভবান হয়। যুদ্ধের আগের চেয়েও রাশিয়া ২৮ শতাংশ লাভ করে এই খাতে। কিন্তু এখন ক্রেতা দেশগুলো নিজ থেকে সরে যাওয়ায় আবার লাভের হার কমে যাচ্ছে। রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক এখন চীন। দুই দেশের মধ্যে ৩০ বছরের চুক্তিও হয়েছে।

খাদ্য সংকট

ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্যসংকট চরম আকারে বাড়িয়ে দিয়েছে। আফ্রিকার ৮৫ শতাংশ মানুষ আমদানি করা গমের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, পাঁচ বছর আগে যে পরিমাণ মানুষ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় ছিল, এখন তার চেয়ে ১০ গুণ বেড়েছে। মূলত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিই খাবারের দাম বাড়িয়েছে। কারণ খাবারের দাম বাড়লে সারের দাম বাড়ে ও পরিবহন খরচ বাড়ে। ফলে কৃষক এবং মধ্যস্বত্বভোগী ও বিক্রেতারা লাভের জন্য খাদ্যপণ্যের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জার্মান ইকোনোমিক ইনস্টিটিউট এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশ্ব তার জিডিপির এক তৃতীয়াংশ হারিয়েছে।

দেউলিয়ার পথে দুই দেশ

দীর্ঘমেয়াদি এই যুদ্ধে দেশে দেশে একদিকে যেমন বেড়েছে অর্থনৈতিক সংকট তেমনি বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বৈদেশিক ঋণের বোঝায় দেউলিয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কা। একই পথের পথিক এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তান।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তিন দশকের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন

বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, যুদ্ধের ধাক্কায় ২০২৩ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসবে। এটা প্রায় তিন দশকের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের গবেষণা বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২৩ সালে তামাম বিশ্বে উৎপাদন ক্ষতির পরিমাণ আরও ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা তার বেশি হতে পারে।

উল্লেখ্য, ইউক্রেনের সেনারা ইতিমধ্যে যদিও রাশিয়ার বাহিনীর দখল করা কিছু এলাকা পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু গত ১২ মাসে রুশ সেনারা ইউক্রেনের যে বিশাল এলাকা ছিনিয়ে নিয়েছে, তার বেশির ভাগ অংশ এখনো রুশ সেনাদের কবজাতেই রয়ে গেছে। এখন তাঁদের মোকাবিলা করতে ইউক্রেন সারা দেশে সেনা সংগ্রহের কার্যক্রম চালাচ্ছে; নতুন নতুন সেনা নিয়োগ করা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে তারা আধুনিক অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ সহায়তা পাচ্ছে। 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top