বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পর্ব-১

বিবাহিতার সাতকাহন

নিজস্ব প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারী ২০২৩, ১১:১৭

বিবাহিতার সাতকাহন

বিবাহিতার সাতকাহন
পর্ব-১

লেখক: শারমিন আঁচল নিপা


আমি বিবাহিতা কিন্তু পথভ্রষ্টা । ১২ বছর হলো সংসারের। কিন্তু আমার কখনই স্বামীর প্রতি টান কাজ করে না। অদ্ভুত রকম অনুভূতি আসে না। আমার সাজানো স্বপ্ন ঘিরে তাকে কল্পনা করতে পারি না।

কারণ আমার অনুভূতির সংমিশ্রণ জুড়ে মিশে আছে আমার সামনের ফ্ল্যাটে থাকা এক পুরুষ। যে কি'না আমার সাত বছরের ছোটো।

আমার ছোটো ছোটো চাওয়া গুলো কখনই আমার স্বামী পূরণ করে নি। আমি হাজার বার সাজলেও আমার স্বামী কখনও আমাকে সুন্দর বলে নি। কখনও বলে নি তোমাকে পরীর মতো লাগছে। বরং সবসময় তিনি তার কাজে ব্যস্ত। পেশায় তিনি একজন পুলিশ অফিসার। সারাদিন থানা পুলিশ করতে করতেই যায় তার। কখনও সে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে না খেয়েছি কি'না। রাত জেগে তার জন্য জেগে থাকলেও সে কখনও অফিস থেকে ফিরে আমার কপালে চুমু আঁকে না। স্বামী স্ত্রী এর মধ্যকার রোমান্সটা আমি খুব বেশি মিস করি। স্বামী, স্ত্রী এর স্বাভাবিক যে চাহিদা সেটা হয়তো কোনো না কোনো ভাবে পূরণ হয়ে যায় তবে মধ্যকার যে ভালোবাসা সেটা কখনও সে পূরণ করতে পারে নি।

লোকে এ কথা শুনলে আমাকে খারাপ বলবে। স্বামী রেখে যে নারী অন্য পুরুষের প্রতি দুর্বল হয় সে নারী তো আর লোকের চোখে ভালো হতে পারে না। সে নারীকে হয় নষ্টা বলবে নাহয় কলঙ্কিনি।

আরও পড়ুন: আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

আচ্ছা ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আসলে হয়তো আমাদের বিষয়টা অনুধাবন করতে সহজ হবে। তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করি জীবনের প্রতিচ্ছবির গল্পটা। ফিরে যাই বারো বছর আগে।

আমি মুমু। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। রসায়ন বিভাগে অধ্যয়নরত আছি। বাবা,মায়ের পছন্দে বেশ ঘটা করেই আমার বিয়ে হয়। সাত ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোটো থাকায় আমার বিয়ের আয়োজনও করা হয় ঝাঁকজমকভাবে। সে সাথে শ্বশুড় বাড়িতে সব কিছু দিয়েই পাঠানো হয় আমাকে।

বিয়ে হওয়ার পর সব মেয়ের মতোই আমাকে আনা হয় শ্বশুড় বাড়িতে। বাঙ্গালি সকল রিতীনিতী মেনেই আমাকে ঘরে তুলা হয়।

আপাতত এক ঘরে বসে মুখের উপর আস্তরণ পরা মেকআপ গুলো তুলতে লাগলাম। সাথে আরও কয়েকজন ছিল সাহায্যের জন্য। আস্তে আস্তে মেকআপ তুলা এবং ফ্রেশ হতে হতেই রাত তিনটে বেজে গেল। পেটটা বেশ মোচড় দিচ্ছে খাবারের জন্য। বিয়ের চিন্তায় গত রাতও ঘুম হয়নি। আর সকাল থেকে খাওয়াও নেই। সব মিলিয়ে মাথাও বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখ বারবার ঘোলা হয়ে আসলেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। মুখ ফুটে খাবারের কথা বলতেও পারছি না আর তারাও খাবার দিচ্ছে না৷ আর একটু আড়াল হয়ে যে স্বামীকে বলব সে সুযোগ ও নেই। উনার সাথে বিয়ের আগে আমার কথা হয়েছে দুবার তাও টুকটাক। ঐরকমও ফ্রিও হয়নি যে উনাকে বলব খাবারের কথাটা সবাইকে বলতে। আর দুজনের বয়সের পার্থক্য ও ১২ বছরের মতো। সবমিলিয়ে বিয়ের আগে সেভাবে কথাটা এগিয়ে নিতে পারিনি।

সময় যেতে যেতে আরও এক ঘন্টা পার হলো। কানে আসলো আমার স্বামী তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে অন্য রুমে আর সেখানেই খেয়ে নিয়েছে। তবে আমার যে ক্ষুধা লেগেছে সেদিকে হয়তো তার খেয়াল নেই৷ আমি বিষয়টা এত জটিল করেও নিইনি তখন। কিন্তু আচমকা মাথাটা ঘুরে গেল। চোখটা ঝাঁপসা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে সব উল্টে যাচ্ছে। সাথে সাথে আমিও ঢলে পড়লাম। কানে শুধু শ্বাশুড়ি মায়ের গলাটা ধেয়ে আসলো। তিনি সবার সামনে বলে উঠলেন

"কী রোগা বউ বিয়ে করিয়ে এনেছি৷ আমার ছেলের তো এ মেয়েকে চিকিৎসা করাতে করাতেই টাকা শেষ হয়ে যাবে। প্রথম দিন এসেই ফিট হয়ে পড়ে গেছে৷"

তিনি আরও বিলাপ জুড়ে দিলেন তবে সেটা বেশিক্ষণ শুনার মতো অবস্থায় আমি রইলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার গলার আওয়াজ আমার কানে মৃদু হতে লাগল আর আমি জ্ঞান হারালাম।

জ্ঞান ফিরল একঘন্টা পর। আমাকে ধরে ধরে নানী শ্বাশুড়ি স্যালাইন খাওয়ালেন৷ চাচী শ্বাশুড়ি এসে ভাত দিয়ে গেলেন। বিয়ে বাড়ির হরেক রকম খাবারের মধ্যে আমার কপালে জুটল কেবল পাতিলের তলানী পড়া পুড়া ভাত আর ডাল। চাচী শ্বাশুড়ি ভাত গুলো দেওয়ার পর হাসতে হাসতে বললেন

"আমরা তো ভুলেই গিয়েছিলাম তোমার খাওয়া হয়নি৷ সবাই খাওয়ার পর যা অবশিষ্ট ছিল কাজের লোকদের দিয়ে দিয়েছিলাম। একটু আগে মনে হলো তুমি খাওনি৷ তাই যেটুকু ছিল নিয়ে এসেছি৷ খেয়ে নাও। মনে কিছু নিও না।"

আমি চাচী শ্বাশুড়ির কথা শুনে হালকা হাসলাম। যে আমি বাড়িতে কখনও ঠান্ডা ভাত খাইনি সে আমার কপালে জুটল পুড়া ভাত। তবে পেটের ক্ষুধার কাছে এ পুড়া ভাতও অমৃত। তাই প্লেট টা নিয়ে আর কোনো কথা না বলে বড়ো বড়ো লোকমা তুলে ভাত গুলো সব চেটেপুটে খেয়ে নিলাম। এর মধ্যেই খালা শ্বাশুড়ি এসে একটু জোরে জোরে হেসে বলল

"নুহাশের বউ তো খেয়েই সব শেষ করে দিবে। মা গো মা মেয়েরা এভাবে খায় নাকি? পুড়া ভাতেই যেভাবে খেয়েছো না'জানি পোলাও ভাত হলে কী করতে। আচ্ছা বউ আমার কথায় মন ধরো না মজা করে বললাম। তুমি কিছু মনে করো নি তো?"

আমার স্বামীর নাম নুহাশ৷ চাচী শ্বাশুড়ির কথা শুনে আমি শুধু মুচকি হাসলাম। ততক্ষণে সকাল ৬ টা বাজে। আমার চোখ দুটো শুধু আমার স্বামীকে খুঁজছিল। এক নজর যদি তাকে দেখতে পারতাম আর সে যদি দেখতে আসত। কত স্বপ্ন ছিল বাসর ঘরে তার সাথে বসে রঙ বেরঙয়ের কথা বলব। কিন্তু স্বপ্ন কখনও বাস্তবতায় রূপ নেয়া না সেটা বুঝতে পারছি এখন।

দেখতে দেখতে সকাল আটটা বেজে গেল। ঘুমে চোখ দুটো লাল হয়ে মাথা ব্যথা করতে লাগল। আমি এখনও আমার স্বামীকে মনে মনে খুঁজছি। এতক্ষণে কী তার একটা বারও আমাকে দেখার ইচ্ছা জাগে নি? এসবেই ভাবতে লাগলাম। একটা পর্যায়ে এসে লজ্জা ভেঙে নানী শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম

"নানী নুহাশ কোথায়? আসার পর থেকে তো একবারও দেখলাম না।"

নানী শ্বাশুড়ি বেশ হেসেই জবাব দিল

"আমার নাতিকে এখনই চোখে হারাচ্ছিস তাই না? হারাবিই তো এমন স্বামী পাইতে তো কপাল লাগে। তোর তো রাজ কপাল। তোর জাত কূলে কেউ এমন স্বামী পেয়েছে নাকি? কিন্তু আমার নাতি তো তার কাজের জায়গায় চলে গেছে। আগামি সপ্তাহে আসবে। সকাল সাতটায় গেছে। জরুরি কাজ ছিল।"

আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। সত্যিই তো এমন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার শ্বশুড় বাড়ি রাজশাহীতে আর স্বামীর পোস্টিং বগুরায়। জরুরি তলবে সে কাজে যেতেই পারে এতে আমার কোনো অভিযোগ নেই কিন্তু আমাকে তো একটু দেখে যেতে পারত। অথবা ফোন নম্বর তো ছিল মোবাইলে একটা মেসেজ দিয়ে যেতে পারত। এসব ভেবে পুনরায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।

বিয়ের আগে সবাই বলেছিল আমার ভাগ্য অনেক ভালো তাই বিসিএস ক্যাডার স্বামী পাচ্ছি। স্বচ্ছল পরিবারে আমার বিয়ে হচ্ছে৷ পাত্রের বাবাও প্রথম শ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তা। পাত্রের মা কলেজের প্রফেসর। সব মিলিয়ে এমন পরিবারে বিয়ে হওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। তবে ভাগ্য হয়তো এত ভালো না হলেও হত। আচ্ছা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়েই কী সব বিচার করা জরুরি নাকি মানবিক শিক্ষা প্রয়োজন। এত শিক্ষিত পরিবারে বিয়ে হয়েছে তবে কথা গুলো শুনে শুধু ভাবতে লাগলাম তারা শিক্ষিত হয়েছে তবে শিক্ষার আলো তাদের স্পর্শ করতে পারে নি।

আমি চুপচাপ বসে আছি। আর কোনো কথা না বলে খাটেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি৷ ঘুমটা ভাঙলো শ্বাশুড়ি মায়ের কান্নার সুরে। আমি কিছুটা হুড়মুড়িয়ে উঠলাম। শ্বাশুড়ি মা বেশ বিলাপ জুড়ে কান্না করতেছে। আমি বুঝতে পারছি না কী হয়েছে। তবে বুঝার চেষ্টা করতে গিয়ে যেন জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিলাম।

সূত্র: লেখকের ফেসবুক থেকে



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top