মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পর্ব-২

বিবাহিতার সাতকাহন

নিজস্ব প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারী ২০২৩, ১০:৪০

বিবাহিতার সাতকাহন

বিবাহিতার সাতকাহন

পর্ব-২

লেখক: শারমিন আঁচল নিপা

 

শ্বাশুড়ি মা কেঁদে বলে উঠলেন

"এমন জায়গায় বিয়ে করিয়েছি বউয়ের বাড়ি থেকে সব পুরনো জিনিস পত্র দিয়ে পাঠিয়েছে। একটা ভালো কাপড়ও দেয় নি৷ সব ফকিন্নির দল। আমার ছেলেটার কপাল পুড়লো। এমন বিসিএস ক্যাডার ছেলেকে সবাই বাড়ি ঘর দিয়ে বিয়ে করায়। আমার ছেলে এ মেয়েকে দেখে কী মজা মজেছে যে একেই বিয়ে করবে। আমার কথা শুনল না। বিসিএস ক্যাডার বানাইলাম আর এর প্রতিদান এই পাইলাম। আমার চাচাত বোনের মেয়েকে বিয়ে করালে তো ঢাকায় বাড়ি পেতাম।"

শ্বাশুড়ি মায়ের কথা শুনে আমি হতবাক। আমার বাসা থেকে ঘরের জিনিস পত্র আসতে একটু দেরি করেছে। একটু আগে ট্রাকে করে সকল জিনিসপত্র এ বাসায় পৌঁছেছে। ফার্নিচার গুলো আমি ঢাকা থেকে পছন্দ করে কিনেছি। সুতরাং আমি জানি এসবের দাম কেমন। এত ভালো ভালো ফর্নিচার দেওয়া হলো তারপরও এত অভিযোগ! আমি শুধু হালকা গলায় জবাব দিলাম

"মা ফার্নিচার গুলো তো আমি পছন্দ করে এনেছি তাই আমি জানি এগুলোর দাম কেমন। এগুলো কিন্তু মা কাঠ ভালো। আপনি একটু ভালো করে দেখুন বুঝতে পারবেন।"

আমার কথা শুনে শ্বাশুড়ি মা আরও রেগে গিয়ে মুখের উপর উত্তর দিলেন

"তুমি আবার কাঠ চিনাও আমাকে? আমি চিনি না নাকি? এগুলা কেমন দাম জানি। আমাদের বাসার কাজের লোকের বাড়িতে এগুলো থাকে। মান সম্মান ইজ্জত আত্মীয় স্বজনের সামনে রইল না। ফকিন্নি বিয়ে করিয়ে এনেছি। জাত ফকিন্নি।"

কথা গুলো বলে উনি রাগে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ বসে আছি। কথা গুলোর উত্তর আমি দিতে পারতাম তবে নতুন বউ উত্তর দিলে বেয়াদব বলেই গন্য হবে। আর সাথে জাত পাত তুলে কথা তো আছেই। তাই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বসে রইলাম। মোবাইলটা বারবার চেক করতে লাগলাম আমার স্বামী কখন কল বা মেসেজ দিবে। দুর্ভাগ্যবশত তিনি আর সারাদিন কল আর মেসেজ দিলেন না।

সারাদিনে সকালের নাস্তাটা হুমধুমে কপালে জুটেনি। দুপুরে বেশ ভালো করেই খাওয়া হয়েছে। দুদিন পর রিসিপশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আমাদের বাড়ি থেকে মানুষজন আসবে আর আমার স্বামীর বাড়ির লোকজনও আসবে। আমার স্বামীর ছুটি পরশু হবে তাই তারিখও সে অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে।

আমি শুধু আমার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছি। বারবার আশা করছি আমার ফোনে একটা কল আসুক। আমার স্বামী আমাকে কল দিয়ে মিষ্টি সুরে বলুক। মুমু তোমাকে কাজের চাপে সময় দিতে পারিনি কিছু মনে করো না। নিজের খেয়াল রেখো। কিন্তু আমার সব আশায় পানি ঢেলে দিল আমার ননদ। সে এসে আমাকে বলল

"ভাবী ভাইয়া অনেক রাগ করেছে।"

আমি তার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম

"কেন?"

"রাগ করবে না কেন বলো? এই যে ভাইয়া গিয়েছে তুমি কি তাকে একটা বারের জন্য কল দিয়ে খোঁজ নিয়েছো? ঠিকমতো পৌঁছেছে কি'না জিজ্ঞেস করেছো? কেমন বউ তুমি স্বামীর খোঁজখবর নাও না। আমাদের বিষয় নাহয় বাদেই দিলাম। আমাদের সুখে থাকা নিয়ে কোনো আপত্তিও নেই। কিন্তু ভাইয়াও যদি এরকম অসুখে থাকে তখন কী চলে বলো। আমিও তো বিয়ে করেছি, কোথায় আমার সানিয়ার বাবা তো আমার উপর এমন অভিযোগ তুলে নি। সংসার জীবনে অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। যাইহোক সময় করে ভাইয়াকে কল দিয়ে রাগ ভাঙ্গিও। নাহয় দেখা যাবে ভাইয়ার যে রাগ অনুষ্ঠানের দিনও কাজের বাহানা দিয়ে আসবে না।"

কথাগুলো একদমে বলে আমার ননদ নাহিদা চলে গেল। আমি দম ধরে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। শ্বাসও ফেলতে পারছি না। মনে হচ্ছে দমটা আটকে যাচ্ছে। দীর্ঘ শ্বাস হয়ে কিছুক্ষণ পর দমটা আঁচড়ে পড়ল। আমার ভেতরটায় অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। কাউকে বলতেও পারছি না আবার সহ্য করতেও।

বিয়ের এক মাস আগে বাবা মারা গেছে। এখন আবার মাকে কল দিয়ে এসব বললে মা স্বাভাবিক থাকতে পারবে না তাই চুপচাপ সব সহ্য করে নিলাম। মোবাইলটা হাতে নিলাম। যার কলের অপেক্ষা করছিলাম সে তো আমার অভিমান বুঝলই না উল্টা রাগ করে বসে রইল। আমি তার স্ত্রী আমার তো একারেই দায়িত্ব তার রাগ ভাঙানোর। আমি মনে মনে হাসলাম। সুখের হাসি নয় বরং যন্ত্রণায় পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাওয়ার হাসি। তারপর তাকে কল দিলাম৷ পরপর দুটো কল দিলাম ধরল না। তিন নম্বর কলটা ধরল। আমি হালকা গলায় বললাম

"হ্যালো। কেমন আছেন? ঠিকমতো পৌঁছেছেন? আমি তো সারাদিন আপনার কলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আপনাকে অনেক মিস করতেছি। আপনি কবে আসবেন?"

উত্তর আসলো

"সারাদিন মিস করলে তো কলেই দিতে। যাইহোক আসব রিসিপশনের আগের দিন। তোমার শরীর কেমন? খাওয়া দাওয়া হয়েছে? যদিও আমার মা তোমার অনেক যত্ন নিবেন জানি তারপরও জিজ্ঞেস করা। মা কী করে?"

আমি লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে বললাম

"হুম সবাই খুব যত্ন করছে৷ আপনার মায়ের একটু মন খারাপ। আমাদের বাসা থেকে যে জিনিসপত্র পাঠিয়েছে এটা উনার পছন্দ হয়নি তাই৷"

নুহাশ রেগে গিয়ে বলল

"শুধু শুধু মায়ের নামে এমন কথা বলো না তো। মা মোটেও এমন না। তোমাদের বাসা থেকে কী আসবে না আসবে তাতে মায়ের মাথা ব্যথা হবার কথা না। মাকে কলটা দাও তো।"

আমি বিছানা থেকে উঠে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে মাকে খুঁজে হাতে ফোন দিয়ে বললাম

"আপনার ছেলে আপনাকে চায়ছে।"

মা আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে হাসি গলায় বলল

"বাবা কেমন আছো?"

ওপাশ থেকে উত্তর আসলো।

"মা ভালো আছি। মুমু বলল তোমার নাকি মন খারাপ। তাদের বাসা থেকে যা পাঠিয়েছি তা নাকি তোমার পছন্দ হয়নি।"

নুহাশের কথা শুনে শ্বাশুড়ি মা রেগে গিয়ে বললেন

"তোর বউ দুদিন হলো না আসলো আর এখনই আমার উপর মিথ্যা তুলে দিল। আমার কেন পছন্দ হবে না? সংসার করবি তোরা। তোদের পছন্দ হলেই হলো। আর আমি কী তোর শ্বশুর বাড়ির টাকায় চলি নাকি যে এসব নিয়ে পড়ে থাকব আর তাদের কাছে কিছু আশা করব। এসব করতেছে তোর আর আমার সম্পর্কটা নষ্ট করার জন্য। তোর বউকে বলে দে, মিথ্যা চালাচালি আর তোর কানে আমার নামে বিষ ঢালা বন্ধ করতে। "

কথাটা বলেই শ্বাশুড় মা আমার কাছে মোবাইলটা দিল। আমি মোবাইলটা ধরতেই নুহাশ বলে উঠল

"তোমার কাছে এমনটা আশা করিনি মুমু। যাইহোক যা হবার তো হয়েছে৷ আমার মনে হয় তুমি এমনটা করেছো কারও কথা শুনে। আমি জানি তুমি যথেষ্ঠ ভালো। এমনিতে কানপড়া দিয়েছে হয়তো কেউ তাই আমার মায়ের নামে মিথ্যা বলেছো। তবে তুমি বুঝবান এমনটা আর করবে না। পরে কথা হবে।"

কলটা কেটে গেল। কলটা কেটে যেতেই শ্বাশুড়ি মা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল

"আমার আর আমার ছেলের মধ্যে এসেই ঝগড়া লাগাতে চাচ্ছ? তোমার সাহস তো কম না। "

আমি কোনো কথায় বললাম না আর। চুপচাপ শুনে গেলাম। রুমে এসে কাঁদতে লাগলাম। নুহাশ তো বিষয়টা একবার যাচাই করে নিতে পারত। তা না করে সরাসরি মিথ্যাবাদী অপবাদ দিয়ে দিল৷ আর শুনেছি মায়েরা কখনও পর হয় না। সব মা জাতিই এক। তাহলে আমার শ্বাশুড়ি মায়েই বা কেন আমার নামে মিথ্যা বলল। আমি তো উনার মেয়ের মতো। উনারও একটা মেয়ে আছে। আমার মা ও তো শ্বাশুড়ি হয়েছে। আমার মায়ের সাথে আমার ভাবিদের কথা কাটাকাটি হলে ও সেটা মিটমাট হয়ে যায় কিন্তু ভাইদের কান পর্যন্ত যায় না। বউ শ্বাশুড়ি সম্পর্ক অনেক ভালো হবে সেটা তো আশা করা বোকামি তবে আমার মা আর ভাবিদের মধ্যকার সম্পর্কেও এত প্যাঁচ দেখিনি। আমার মা অনেক ভালো শ্বাশুড়ি বলব না তবে এতটাও খারাপ না। আমাদের পরিবারে আমার চার ভাইয়ের বউ থাকে। বিয়ের প্রথম দিন থেকে অন্তত এ সমস্যা গুলো দেখিনি। বেশিদিন থাকার মধ্যে টুকটাক বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে। তবে আমার মতো বিয়ের দিন থেকেই এত যন্ত্রণা পুহাতে হয়নি আমার ভাবীদের। এসব ভেবেই কাঁদতে লাগলাম।

এ সময় আগমন ঘটল আমার শ্বশুড় বাবার। আর সে সাথে শুরু হলো নতুন ঘটনা।

সূত্র: লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top