বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পর্ব- ৩

বিবাহিতার সাতকাহন

নিজস্ব প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০২:০৪

বিবাহিতার সাতকাহন

বিবাহিতার সাতকাহন

পর্ব- ৩

লেখক: শারমিন আঁচল নিপা

 

শ্বশুড় বাবা আস্তে গলায় বলল

"মা তোমার চোখে পানি কেন?"

ভেবেছিলাম তিনি আমার দুঃখ বুঝবেন অন্তত। একটা বাড়ির সবাই তো আর একরকম হয় না। শেষ ভরসা নিয়ে মৃদু গলায় উত্তর দিলাম

"বাবা এমনি বাড়ির কথা মনে পড়ছে তো তাই। আর মা ও আমাকে ভুল বুঝলো। নুহাশও ভুল বুঝলো। বাবা আমি এমন কিছু করেনি যে মা আর নুহাশের মধ্যে ঝামেলা হোক।"

বাবা অবশ্য আমাকে রাগ গলায় কিছু বলে নি৷ তবে মিষ্টি কথায় কীভাবে জুতাঘাত করা যায় সেটা অবশ্য বাবা ভালো করেই জানেন। তাই তিনি বেশ শান্ত গলায় আমাকে বুঝিয়ে বললেন

"দেখো মা শ্বশুড় বাড়িতে সব মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়। তোমার শ্বাশুড়িকে বিয়ের পর আমি কাঁদতে দেখিনি। আজকে যেহেতু কেঁদেছে কোনো কারণ ছাড়া তো আর কাঁদেনি। আমি জানি তুমি যা বলছো তাও ঠিক তবে মা নুহাশের মতো আমারও মনে হয় তোমাকে হয়তো কেউ কানপড়া দিয়েছে। বলব কী অন্যের কথায় নিজের সংসারে অশান্তি ডেকে এনো না। আমরা তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করিয়ে এনেছি এখন এমন কোনো কাজ করো না যেটাতে আমাদের পছন্দ অপছন্দতে পরিণত হয়। আর সামনে তো রিসিপশন। তোমার বাবা বাড়ি থেকে নুহাশের জন্য স্যুট পাঠাবে না? এর মধ্যে তো মাপ নিল না।"

আমি চুপচাপ উত্তর দিলাম

"কনের বাড়ি থেকে যে স্যুট পাঠাতে হয় তা তো আমাদের জানা নেই বাবা। আমি মা আর ভাই, বোনকে বলে দিব। "

শ্বশুড় বাবা একটু বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন

"এটা কী জানতে হয় নাকি? কমনসেন্সের ব্যাপার। আমরা তো তোমার পরিবার থেকে কোনো কিছু ডিমান্ড করিনি৷ যা দিয়েছো উপহার হিসেবে নিয়েছি। কিন্তু পরিবেশ আর রিতীনিতী তো জানতে হবে। তোমার মা এত গুলো বোন ভাই বিয়ে দিয়েছে, নিয়েছে তোমরা কী এগুলা জানো না নাকি? "

আমি হালকা গলায় জবাব দিলাম

"আমার বড়ো বোনদের সময় এরকম কিছু করেনি তো তাই জানা নেই। বাবা আপনি চিন্তা করবেন না আমি বলে দিব। তারা পাঠিয়ে দিবেন।"

শ্বশুড় বাবা কথা বাড়ালেন না তিনি চলে গেলেন। আমি আমার বড়ো বোনকে কল দিয়ে সবটা বলার পর সে বলল

"প্রথম প্রথম এডজাস্ট হতে সময় লাগে একটু মানিয়ে নে। আর ওরা যখন আমাদের দেওয়া ফার্নিচার পছন্দ করেনি এত দাম দিয়ে দেওয়ার পরও। তাই এবার স্যুটের জন্য ২০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই। উনারা উনাদের পছন্দ মতো কিনে নিবেন। আমি অরুনকে দিয়ে কালকের মধ্যেই টাকা পাঠিয়ে দিব। "

আমি শুধু হুম উত্তর দিলাম। কারণ আপু বিষয়টা মন্দ বলে নি। এতে অন্তত আমাকে আর কথা শুনতে হবে না। এত বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না।

কিছুক্ষণ পর নুহাশ আবারও কল দিল। আমি কলটা ধরতেই বলে উঠল
"তুমি নাকি সারাদিন কান্নাকাটি করো। আচ্ছা মুমু তোমার কী এ বিয়েতে মত ছিল না? নাকি তোমার অন্য কোথাও সম্পর্ক ছিল। আসার পর থেকেই কেঁদেই যাচ্ছ। বাড়ির সবাই কল দিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করে তুমি কেন এত কান্না করো।"

আমার নুহাশের কথা শুনে হাসি পাচ্ছে। আমার নাকি অন্য কোথাও সম্পর্ক থাকতে পারে তাই কান্নাকাটি করছি। আমি একটু হেসে জবাব দিলাম

"নুহাশ সম্পর্ক থাকলে কেন আপনাকে বিয়ে করেছি? যার সাথে সম্পর্ক তাকেই তো বিয়ে করতে পারতাম৷ আর আমি তো বাচ্চা মেয়ে না যে বাবা, মা জোর করে বিয়ে দিবে৷ বাসার জন্য মন খারাপ লাগছে। আপনি পাশে নেই। নতুনপরিবেশ মানাতে কষ্ট হচ্ছে। তাই কান্নাকাটি করছি এর বাইরে কিছুনা।"

"তবে মা যে বলল।"

আমি হালকা কাশি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

"কেন মা কী বলেছে?"

নুহাশ প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে বলল

"কিছু না৷ তোমার শরীর কেমন? আর কান্নাকাটি করো না। আমি রিসিপশনের সময় সাতদিনের ছুটি নিয়ে আসব৷ তখন তোমাকে ভালোভাবে সময় দিতে পারব। হুট করে বিয়ে তো তাই একটু এলোমেলো হয়ে গেছে সব।"

"হুম।"

কলটা কেটে গেল। আমি চুপ করে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছি। একটু কী বুঝার মতো কেউ নেই। সত্যিই কেউ নেই৷ নিজেকে নিজেই বুঝতে হয়। বিয়ের আগে কখনও প্রেম করিনি স্বামীকে ভালোবাসব তাই। আর সে স্বামী কিনা আজকে যাচাই না করেই এত বড়ো কথা বলে দিল। সত্যি বলতে কপালে সুখ না থাকলে এমনি এমনি আসবে না। সহ্য করে যাই। এছাড়া উপায় তো নাই। ডিভোর্স হলে সমাজ আড় চোখে তাকাবে। এর চেয়ে বরং এখনই ধুকে ধুকে মরি। মরলে তো ধুকে ধুকেই মরতে হবে। ডিভোর্স হলেও তো ভালোভাবে বাঁচার উপায় নেই।

সকাল ১১ টা বাজে। টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছিলাম। এ সময় আমার ভাই অরুন আসলো। আমি টেবিলে বসে খেয়ে যাচ্ছি। শ্বাশুড়ি মা অরুন ভাইয়ের সাথে কুশল বিনিময় করে সোফায় বসলো। অরুন ভাই একটা টাকার খাম শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল

"মামনি সাব আমরা তো স্যুট কিনিনি৷ আর মাপ ও জানি না। আর আমাদের পছন্দ করা স্যুট যদি মুমুর জামাইয়ের পছন্দ নাহয়। সেজন্য আমার মা ২০ হাজার টাকা মুমুর জামাইয়ের জন্য পাঠিয়েছে। মেহেরবানি করে এ টাকা দিয়ে যদি স্যুটটা কিনতেন খুশি হতাম।"

শ্বাশুড়ি মা রেগে গিয়ে টাকার খামটা ছুড়ে দিয়ে বলল

" আমরা কী ফকিন্নি নাকি যে টাকা নিব। আমার ছেলেটার যে জায়গায় পোস্টিং হয়েছে সেখানে গিয়েও তো ওকে নিয়ে পছন্দমতো স্যুট কিনে দেওয়া যেত। এভাবে টাকা দিয়ে অপমান করার দরকার ছিল না।"
আমি তখন মুখে ভাতের লোকমা টা সবে নিয়েছিলাম। উনার কথা শুনে লোকমাটা গিলতেও পারছিলাম না আর ফেলে দিতেও। এ ভাত গলা দিয়ে নামাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবু শত কষ্ট চাপা দিয়ে খাবারটা গিলে নিলাম। সবসময় তো কথা গুলো হজম করেই গিলতে হবে৷ এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।

অরুন ভাই চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে আছে। হয়তো বোনের সুখের জন্য কোনো কথা বলছে না। অথচ এ মানুষটা কেউ একটা কথা বললে তাকে দশটা কথা ফেরত দেয়। সব শ্বশুড় বাড়ি এক না৷ আমার বড়ো বোনদের শ্বশুড় বাড়িতে এমন সমস্যায় পড়তে হয়নি কখনও। তাই বিষয়গুলোর সাথে আমার ভাইয়েরাও পরিচিত না।

থমথমা পরিবেশ। শ্বশুর বাবা কোথায় থেকে যেন আসলো। টাকা গুলো মেঝে থেকে নিয়ে অরুন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল

"বাবা তোমার মামনি সাবের কথায় রাগ করো না। ছেলেকে অনেক বেশি ভালোবাসে তো তাই এমনটা করে ফেলেছে। আমি টাকা গুলো নিয়ে নুহাশকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছি বাকিটা সে তার পছন্দমতো কিনে নিবে৷"

তারপর শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন

"নুহাশের মা সবাই এক না। বিষয়টা এভাবে রাগ না করলেও পারতে। নতুন বউ কী ভাববে বলো। আর বুঝিয়ে বলা যেত। "

শ্বাশুড়ি মা ভারী গলায় উত্তর দিল

"এতসব বুঝাতে পারব না। আমারেই কপাল পুড়া। তাই একমাত্র ছেলের কপালে এমন ছেলের বউ জুটেছে।"

এক দমে কথা গুলো বলে তিনি উঠে চলে গেলেন। আমি শুধু চুপচাপ বসে আছি। অরুন ভাইয়ের দিকে তাকাতেই সেও আমার দিকে অসহায় চোখে তাকাল। শ্বশুড় বাবা পরাস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য অরুন ভাইকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

আমি বাকি খাবার খাচ্ছি আর চোখ দিয়ে জল ফেলছি। এর মধ্যে কানে ধেয়ে আসলো কিছু বাক্য। যা শুনে পুনরায় চোখ বেয়ে পানি ঝড়াতে চেয়েও আটকে নিলাম।

সূত্র: লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top