শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আধা ঘণ্টার গরম বাতাসে স্বপ্ন শেষ শত শত কৃষকের

গোপালগঞ্জ থেকে | প্রকাশিত: ৬ এপ্রিল ২০২১, ২১:০১

আধা ঘণ্টার গরম বাতাসে স্বপ্ন শেষ শত শত কৃষকের

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামের শেফালী বিশ্বাস (৫৮)। ঘরে অসুস্থ পঙ্গু স্বামী আর চার মেয়ে। এবার ৩ বিঘা জমিতে ধান বুনে স্বপ্ন দেখেছিলেন ঘরে তোলার। যাতে সারা বছরের খাবার যোগান হয়। কিন্তু কালবৈশাখী ঝড়ের পরেই মাত্র কয়েক মিনিটের গরম বাতাসে তার সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এখন চিন্তায় রয়েছেন কি ভাবে যোগান হবে সারা বছরের খাবার। কি ভাবেই বা চলবে সংসার।

শুধু শেফালী বিশ্বাসই নয় তার মত একই অবস্থা ওই গ্রামের অপর্না রানী খান, দয়ানন্দ ঘরামী, জুড়ান বিশ্বাস, সুরেশ সেন, চিত্তরঞ্জন ঘরামী, দেবাশিষ মন্ডলসহ জেলার চার উপজেলার শত শত কৃষকের।

এক রাতের মধ্যে শত শত হেক্টর জমির ধানের শীষ সবুজ থেকে সাদা হয়ে নষ্ট হয়েছে। কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন লু হাওয়ার কারনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। জেলার অন্ততঃ ১০টি ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। ইতিমধ্যে কৃষি বিভাগ খবর পেয়ে ক্ষতির পরিমান নিরুপনে মাঠে নেমেছে।

 কালবৈশাখী ঝড়ের পরে ধানের শীষ সবুজ থেকে সাদা হয়ে নষ্ট হয়েছে

সরেজমিনে গিয়ে ও গোপালগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, গোপালগঞ্জে এবছর ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এসব জমিতে এখন ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছে। কিন্তু হঠাৎ করে গত রবিবার (০৪ এপ্রিল) রাতে জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া, তাড়াইল, পাকুরতিয়া, লেবুতলা, বর্ণি, কুশলী, পাটগাতী, বরইহাটি ও গোপালপুর, কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের মাচারতারা, আমতলী, তালপুকুরিয়া, কান্দি, পিঞ্জুরী, হিরণ ও আমতলী, কাশিয়ানী উপজেলার রাতইল ও সদর উপজেলার চর মানিদাহ গ্রামের উপর দিয়ে কাল বৈশাখীর গরম হাওয়া প্রবাহিত হয়।

এরপর সোমবার (০৫ এপ্রিল) সকালে কৃষকেরা তাদের জমিতে গিয়ে দেখেন সব ধান সাদা হয়ে গেছে। ক্ষেতের উঠতি বোরো ধানের শীষে যে গুলোতে কেবল মাত্র “দুধ” এসেছে সেই ধানের শীষ সব চিটায় পরিনত হয়ে সাদা বর্ণ ধারন করেছে। যেসব জমিতে ধানের ফ্লাওয়ারিং হচ্ছে সে সব জমির ধান গরম বাতাসে পুড়ে গিয়ে সাদা বর্ণ ধারন করেছে। এতে উৎপাদনের প্রায় শতকরা বিশ ভাগ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আর এতে জেলার শত শত কৃষক কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির সম্মূখীন হয়েছেন। সারা বছর কি খেয়ে দিন কাটাবেন এখন সেই চিন্তায় পড়েছেন তারা। ধার দেনা, ব্যাংক লোন ও ঋণ নিয়ে এসব কৃষকরা তাদের জমিতে ধানের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু ধান নষ্ট হওয়ায় কি ভাবে ধার দেন ও ঋণ শোধ করবেন সেই চিন্তায় দিন কাটছে তাদের।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামের দয়ানন্দ ঘরামী ও জুড়ান বিশ্বাস বলেন, রাতে গ্রামের উপর দিয়ে কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। মাত্র বিশ মিনিটের গরম বাতাসে আমার জমির ধানের শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। এ ছটাক ধানও ঢ়রে তুলতে পারবো না। সারা বছর পরিবার পরিজন নিয়ে কি খাবো চিন্তায় শেষ এখন।

একই গ্রামের অপর্না রানী খান বলেন, আমার স্বামী অসুস্থ। ছোট ছোট দুটো বোচ্চা রয়েছে। আমি নিজ হাতে তিন বিঘা জমিতে ধান লাগাইছি দেনা হয়ে। কিন্তু আমার জমির সব ধান এখন নষ্ট হয়েছে গেছে। এখন আমার আর কোন পথ নেই কোন আয় রোজগার নেই। এখন আমার মরন ছাড়া আর কোন গতি নেই।

একই গ্রামের দেবাশিস মন্ডল, নকুল ঘরামী, চিত্তরঞ্জন ঘরামী বলেন, এ বছর ধার দেনা, ব্যাংক লোন ও ঋণ নিয়ে ধান চাষ করেছি। কিন্তু জমির ধান স্ শেষ হয়ে গেলো। দেশে এখন করোনার সাথে লকডাউন চলছে। সারা বছরের খাবার তো দূরের কথা এখন ধার দেনা কি ভাবে শোধ করবো তা বুঝতেই পারছি না। আমাদের মরণ ছাড়া আর কোন পথ নেই।

একই গ্রামের কৃষক রঞ্জিত সেন, সুরেশ সেন বলেন, রাত ১০টার দিকে কাল বৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার বইতে শুরু করে। এরই এক পর্যায়ে হঠাৎ করে গরম বাতাস আসে। তখন আমরা বুঝতে পারিনি ধানের ক্ষতি হবে। সকালে রোদ ওঠার পর জমিতে গিয়ে দেখি ফুলে বের হওয়া ধানের শীষগুলো শুকিয়ে গেছে। এখন আমরা কি করবো তা বুঝে উঠতে পারছিনা। সরকার যদি আমাকে সাহায্য সহযোগীতা না করে তাহলে ঋণ করে সারা বছর চলতে হবে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো: জামাল উদ্দিন বলেন, কৃষকরা খবর দেয়ার পর আমি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শণ করেছি। সেখানে গিয়ে দেখি জমির ধানগুলো সাদা বর্ণ ধারন করেছে নস্ট হয়ে গেছে। এবছর টুঙ্গিপাড়ায় ৮ হাজার ৬’শ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্ছে।

কোটালীপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিটুল রায় বলেন, ফ্লাওয়ারিং হওয়া ধানে গরম বাতাসের কারণে পরাগায়ন শুকিয়ে গেছে। যে কারণে ধান গাছগুলো ঠিক আছে কিন্তু শীষগুলো শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্ছে কোটালীপাড়ায় প্রায় ৬ থেকে ৭ শত হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপনের কাজ করা হচ্ছে।

জেলার বিভিন্ন স্থানে ধান নষ্ট হবার কথা স্বীকার করে গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, গরম বাতাসে জেলার টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, কাশিয়ানী ও সদর উপজেলার বোরো ধানের বেশ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমান নিরুপনে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে মাঠে কাজ করছে। তবে এখন পযর্ন্ত ক্ষতির পরিমান জানা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা ও ক্ষতির পরিমান লিপিবদ্ধ করার জন্য বলা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিষয়টি ভাঙ্গা ধান গবেষণা ইনিষ্টিটিউটকে জানানো হয়েছে। তাদের একটি দল গোপালগঞ্জে এসে বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবেন। এরপর তারা আমাদের জানিয়ে করণীয় ঠিক করবেন।

এনএফ৭১/এনজেএ/২০২১




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top