দুর্নীতি’র অভিযোগে দুদকের জালে ধরা যত পুলিশ

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৪, ২১:৪১

ছবি: সংগৃহীত

‘দুর্নীতি’র অভিযোগ ও ‘বিপুল পরিমাণ সম্পদ’ নিয়ে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এরইমধ্যে অবৈধ উপায়ে অর্জিত তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বেনজীরের বিরুদ্ধে যে অনুসন্ধান করা হবে, দুদকের এই সিদ্ধান্তের কথা গত ২২ এপ্রিল গণমাধ্যমকে জানান দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। তবে দুদক সূত্র জানায়, সাবেক আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত বিভিন্ন পদমর্যাদার অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। মামলাও হচ্ছে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।

গত ১৩ মে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার তথ্য চেয়ে আইজিপি বরাবর চিঠিও দিয়েছে দুদক। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তথ্য চাওয়া হলেও সেই তথ্য দুদক পেয়েছে কিনা, তা জানা যায়নি।

এসবির এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনেন গোপালগঞ্জের মোচড়া গ্রামের আজম আলী খান। ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট দুদকে দাখিল করা অভিযোগে তিনি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল নম্বর, দাগ-খতিয়ান ও ছবিসহ অভিযোগ তুলে ধরেন। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করে সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। স্পেশাল ব্রাঞ্চের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ ব্যবহার করে চাকরি নেওয়ারও অভিযোগ করা হয়েছে। এসব ঘটনা ছাড়াও নানা কারণে পুলিশ সদস্যদের অনেক অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে।

এসবি’র কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের তথ্য চেয়ে পুলিশ সদর দফতরে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, সেই চিঠি অনুযায়ী তথ্য পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে দুদকের উপ-পরিচালক নুরুল হুদা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তথ্য চাওয়া হয়েছে, তথ্য পাওয়া যাবে।’

দুদকের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, সারা দেশেই অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। অনেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। আবার অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে কারও কারও বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার চার্জশিটও দেওয়া হচ্ছে আদালতে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগই বেশি।

গত ২০ মে মেহেদী হাসান নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে। মেহেদী হাসান বর্তমানে নাটোর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কর্মরত। পুলিশের এই কনস্টেবল তার অবৈধ সম্পদ বৈধ দেখাতে ৪৮টি নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জমি বন্ধক রেখে ১৮ লাখ ও ৩৩ হাজার টাকা ঋণ দেখিয়েছেন।

তবে দুদক অনুসন্ধান করে দেখেছে, জমি বন্ধক ও ঋণচুক্তির সব ডকুমেন্ট ভুয়া। মেহেদী হাসানের নামে ঋণ বাদে অর্জিত সম্পদের প্রকৃত মূল্য ৮১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৮৪ টাকা। তবে তার বিরুদ্ধে দুদক ৬২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে।

কনস্টেবল নিয়োগে ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মাদারীপুরের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) সুব্রত কুমার হালদারসহ তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। গত ৭ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম। এর আগে গত বছরের ৫ জুলাই সুব্রত কুমার হালদারসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য এ আদেশ দেওয়া হয়। গত ৩০ মে শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এই আদেশ দেন। মামলার প্রাথমিক অনুসন্ধানকালে দুদকের পক্ষে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও দুদকের সহকারী পরিচালক রুহুল হক।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় পুলিশের বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানকে ২০২৩ সালের ২১ জুন ১৪ বছরের সাজা দেন নিম্ন আদালত। ডিআইজি মিজানের আপিলের পর সেই সাজা বহাল রেখে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি (২০২৪) আদেশ দেন উচ্চ আদালত। বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করা মিজানুর রহমানের আপিল খারিজ করে দেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় এখনও সাবেক ও বর্তমান অতিরিক্ত আইজিপি ছাড়াও ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, এএসপি, ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর, কনস্টেবলসহ প্রায় সব পদের পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ বাণিজ্য, সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়, আইন অমান্য করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি শেখ হেমায়েত হোসেন, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আলী আশরাফ ভূঞা, উপ-পুলিশ কমিশনার হামিদুল আলম, পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন, খুলনা বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের সাবেক ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. সহিদ হোসেন, ইন্সপেক্টর আবুল বাশার, ইন্সপেক্টর জাবেদ মাসুদ, ইন্সপেক্টর মো. রাসেল, এসআই বাবুল ইসলাম, রূপগঞ্জের ইন্সপেক্টর মাহমুদুল হাসান, এসআই মো. আইয়ুব আলী ও এসআই মনিরুজ্জামানসহ প্রায় তিন ডজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে বলে দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অনুসন্ধানের খবর জানাতে যখন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন সাংবাদিকদের ব্রিফ করছিলেন, তখন বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল—বেনজীর ছাড়াও কতজন পুলিশ কর্মকর্তা দুদকের জালে, কিংবা অনুসন্ধানের তালিকায় আছেন। তখন তিনি এ প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়েও এ বিষয়ে দুদক সচিব আর কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি।

‘দুর্নীতির কারণে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে’ বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়নকর্মী ফারুখ ফয়সল। তিনি বলেন, ‘বেনজীর আহমেদসহ এসব কর্মকর্তার দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন কেউ কিছু বলেনি। এখন বলছে। তখন যে কেউ জানতো না তা কিন্তু নয়। কথা হচ্ছে দুর্নীতি কারা করতে পারে। যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, টাকার উৎস আছে, তারাই পারে। কীভাবে পারে, সরকারের প্রশ্রয়ে পারে। এতে সব সংস্থার ওপর মানুষের যে আস্থা থাকার দরকার, সেই আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের কর্তব্য হচ্ছে সেই আস্থাটাকে ফিরিয়ে আনা।’

তাদের বিরুদ্ধে তো সরকারই ব্যবস্থা নিচ্ছে–এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘এখন বহির্বিশ্বের চাপের ওপর যদি আমরা চলি, তাহলে দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়ে।’ সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক ও বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’ সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের মন্তব্য নিতে পরামর্শ দেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউনের খবর



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top