বিভাজনের ওপারে এক ‘অখণ্ড বাঙালিত্বের’ নির্মাতা
বিনোদন ডেস্ক | প্রকাশিত: ৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:১২
ঢাকায় জন্ম, কলকাতায় মৃত্যু—তবু ঋত্বিক ঘটক আজও জীবন্ত তাঁর হারানো ভূখণ্ডে, পিতৃভূমিতে। জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে। আজ তাঁর জন্মশতবর্ষ। সাতচল্লিশের বিভাজনে ভৌগোলিকভাবে দুই বাংলার মধ্যে যে রক্তাক্ত রেখা টানা হয়েছিল, ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র আজও সেই বিভক্তির বিরুদ্ধে এক অমোঘ প্রতিবাদ হয়ে আছে।
দেশভাগের পর তিনি চলে যান পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু তাঁর সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে রয়ে গেছে পদ্মাপারের মাটি, ঢাকার স্মৃতি, পূর্ববঙ্গীয় ব্যথা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’— প্রতিটি চলচ্চিত্রই যেন হারানো এক ভূখণ্ডের আর্তনাদ। তিনি নিজেই বলেছিলেন,
“আমি বাংলা চলচ্চিত্র করি, কারণ আমি বাংলার মানুষদের কথা বলতে চাই।”
তাঁর কাছে ‘বাংলা’ মানে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পুরো বাঙালি জাতি—ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সমষ্টি। সেই জায়গা থেকেই তাঁর সিনেমা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশেরও আত্মপ্রতিকৃতি।
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে রাষ্ট্র ভাগ হলেও মানুষের মন ভাগ হয়নি।
‘কোমল গান্ধার’-এর দুই নাট্যদলের বিভাজন আসলে ভারত–পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাঙনের প্রতীক। আবার ‘সুবর্ণরেখা’-তে চরিত্রদের নদীর ওপারে হারিয়ে যাওয়া—রাষ্ট্রের নয়, বরং মানবিক সংযোগের ব্যাকুলতার ইঙ্গিত।
তিনি বিশ্বাস করতেন, “রাজনীতি যতই বিভক্ত করুক, সংস্কৃতি সবসময় ঐক্য সৃষ্টি করে।”
তাঁর শিল্পচিন্তা ছিল সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের অন্য নাম। ঋত্বিক বলেছিলেন,
“আমি বামপন্থি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আমি বাঙালি।”
এই বক্তব্যেই যেন নিহিত ছিল তাঁর শিল্পের সারকথা—রাষ্ট্রীয় সীমার বাইরে এক অভিন্ন মানবিকতা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিতে ঋত্বিক ঘটক এক অদৃশ্য প্রেরণার উৎস। ‘স্বদেশ’, ‘অভিবাসন’, ‘বঞ্চনা’ বা ‘বিচ্ছেদ’-এর গল্পে আজও তরুণ নির্মাতারা তাঁর উত্তরাধিকার বহন করছেন। তিনি দেখিয়েছিলেন—চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন নয়; এটি জাতির সামষ্টিক স্মৃতির নির্মাতা, তাদের প্রতিবাদের ভাষা।
ঋত্বিক ঘটক ছিলেন সেই মানুষ, যিনি ধর্ম, রাজনীতি ও শ্রেণি–বিভেদের বাইরে গিয়ে এক নতুন ‘মানুষের দেশ’ কল্পনা করেছিলেন—যেখানে বিভাজন নেই, আছে কেবল পুনর্মিলনের তৃষ্ণা।
তবে দুঃখজনক, আজও বাংলাদেশের জাতীয় পাঠ্যক্রম, চলচ্চিত্রশিক্ষা কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে এই মহান চলচ্চিত্রকার প্রায় উপেক্ষিত। অথচ তিনি এই মাটিরই সন্তান, যিনি নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে দুই বাংলাকে সাংস্কৃতিকভাবে একত্র করেছিলেন।
তিনি একবার বলেছিলেন—
“আমার সিনেমা বুঝতে হলে এ জাতির কান্না বুঝতে হবে।”
ঋত্বিক ঘটকের সেই কান্না অখণ্ড বাংলার, এই বাংলাদেশেরও।
জন্মশতবর্ষে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা—
বিভাজনের ওপারে দাঁড়িয়ে, তিনি আজও আমাদের ‘অখণ্ড বাঙালিত্বের’ প্রতীক।
নিফ্লা৭১/ওতু
বিষয়:

পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।