নতুন ভোরের সম্ভাবনা
যুগের চাহিদা মেনে নিরন্তর ছুটে চলা আগামীর সাংবাদিকতা মোজো
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৮ আগষ্ট ২০২৩, ২১:১৬
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সংকল্পে বলেছিলেন, বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে। বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয় বন্দি হয়েছে। পাঠক অভ্যস্ত হয়েছে তার মিনিস্ক্রিনে।
বদলে গেছে মানুষের তথ্য চাহিদার ধরন। সময়ের খবর এখন মানুষ সময়ে চায়। সেই চ্যালেঞ্জের মুখে সাংবাদিকতার ধারাবাহিক বিবর্তন চলমান। হাতে লেখা সংবাদপত্র থেকে মাল্টিমিডিয়া নিউজ পোর্টাল। এর নবতর রূপ মোবাইল জার্নালিজম (মোজো)। স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে যখন সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রচারের কাজ চলে, তখন তাকে মোবাইল সাংবাদিকতা বলে।
সংবাদ সংগ্রহ, পরিবেশন ও পাঠে মোজো কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মিডিয়া ইন্ড্রাস্টিতে মোজো দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সুবিধা আছে বলেইতো মানুষ সেদিকে ছুটছে। কারণ সাংবাদিকদের স্মার্ট ফোনটিই এখন অফিস। যেকোন জায়গা থেকে যে কোন সময় ফোনেই খবর প্রচার সম্ভব।
বাণিজ্য আছে বলে এখানে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। মোজো ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে হলে এর আদ্যপান্ত জানা জরুরি। জানতে হবে মোবাইলে নিউজ লিখে আপ দেওয়া, ভিডিও বা ছবি এডিট করে ব্যবহার করা। এক কথায় আইটিতে হতে হবে দক্ষ। নিজেকে নির্মাণ করতে হবে পড়ুয়া আর মাল্টিটাস্কার হিসেবে।
মিডিয়ায় নিজের সক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিকল্প হয় না। এটি শুধু রিপোর্টারদের জন্য না নিউজরুমের প্রত্যেকের জন্য। কেননা প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত আপগ্রেড হচ্ছে। সেখানে হালনাগাদ না হলে পুরো হাউস পিছিয়ে যাবে।
একজন মোবাইল সাংবাদিককে ফুটেজ সংগ্রহ, ছবি তোলার ব্যাকরণ, ভালো অডিও নেয়ার কলাকৌশল থেকে শুরু করে লাইটিং, সব ব্যাপারেই খুটিনাটি জানতে হবে। জেনে নিতে হবে ক্যামেরা অপারেশন, শট ডিভিশনের নানা আয়োজন। সংক্ষেপে, অনলাইান ও অফলাইন প্রোডাকশনে দক্ষতা।
কারণ মোজোকে বলা হচ্ছে ওয়ান ম্যান আর্মি। একটি যন্ত্র দিয়ে ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন, ভয়েস দিচ্ছেন, এডিট করছেন। তারপর সংবাদ উপযোগী করে পরিবেশন করছেন।
মোজোতে যিনি কাজ করবেন তাকে জানতে হবে-ভিডিও কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি তৈরি ও প্রয়োগ করা। ভিডিও কনটেন্টের জন্য সেরা অনুশীলন গবেষণা করা। নিত্য নতুন কন্টেন্ট ডিজাইন বা পরিকল্পনা করা। কনটেন্ট উপস্থাপনায় সৃজনশীলতা, সাবলীলতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা। সবশেষে চমৎকার আন্তঃযোগাযোগ ও উপস্থাপনা দক্ষতা।
আর একটা সুবিধার কথা সংক্ষেপে বলি। মোবাইলের মাধ্যমে যখন তখন রিয়েল টাইমে লাইফ স্ট্রিমিং করা সম্ভব। কারণ ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট যখন একটি সংবাদ কভার করতে বের হন, সে এক মহা আয়োজন। বিশাল ক্যামেরার সঙ্গে ভারী ট্রাইপট, বুম সঙ্গে একগাদা তার, সাউন্ড ডিভাইস সঙ্গে গাড়িতো আছেই।
এই জায়গাটা একটু একটু করে ভেঙ্গে দিচ্ছে মোবাইল সাংবাদিকতা। দ্রুত, তাৎক্ষণিক, ব্রেকিং নিউজ করার জন্য মোবাইলকেই সবচেয়ে ভালো টুলস হিসেবে বিবেচনা করছে নিউজরুম। ব্রেকিং নিউজের ক্ষেত্রে মোবাইল লাইভ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উৎসে পরিণত হয়েছে। তবে সাংবাদিকতার নীতি মেনে সংবাদ প্রচারে সচেতন হতে হবে মোজোকে।
লিখেছেন রায়হান রাজীব
মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন:
মোবাইল বা ট্যাবলয়েড ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ বা প্রক্রিয়াজাত করে সংবাদ প্রকাশ করাকেই মোবাইল সাংবাদিকতা বলে। তবে বর্তমানে বহনযোগ্য যে কোন ডিভাইস তথা ডিএসএলআর ক্যামেরা, ড্রোন, ল্যাপটপ প্রভৃতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করাকে মোবাইল সাংবাদিকতার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলছেন মোবাইল সাংবাদিকতা বিশেষজ্ঞরা।
মোবাইল শব্দটির অর্থ হচ্ছে সচল বা চলমান। তাই মোবাইল জার্নালিজম বিশেষজ্ঞ অনেকের মতে, এই ধরনের সাংবাদিকতা করার জন্য কেবল মোবাইলই ব্যবহার করতে হবে ব্যাপারটা মোটেও তা-ই নয়। অনেকেই এই ভেবে ভুল করেন মোবাইল জার্নালিজম মানে মোবাইল ব্যবহার করে সাংবাদিকতা। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও এ রকম নয়। একজন রিপোর্টার যখন খুব সহজে যেকোনো স্থানে অবস্থান করে, যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো বিষয়ের খবরাখবর তৎক্ষণাৎ অডিয়েন্সের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন, সেটাই হবে মোবাইল জার্নালিজম।
বিবিসি রেডিও ফাইভ লাইভ-এর মোবাইল জার্নালিস্ট নিক গারনেটের মতে, লোকজন এই ভেবে ভুল করে যে মোবাইল জার্নালিজমের মানেই হচ্ছে মোবাইল ব্যবহার করে সাংবাদিকতা করা। ব্যাপারটা মোটেও এরকম নয়। আসলে মূলত মোবাইল জার্নালিজম হচ্ছে রিপোর্টারের মোবাইল (চলমান অর্থে) হওয়া।
গারনেটের মতে, একজন রিপোর্টার যখন খুব সহজে যেকোনো স্থানে অবস্থান করে, যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো বিষয়ের খবরাখবর তৎক্ষণাৎ অডিয়েন্সের সাথে শেয়ার করতে পারবেন, সেটাই হবে মোবাইল জার্নালিজম। চিরায়ত পদ্ধতিতে সাংবাদিকতা করতে হলে একজন রিপোর্টারকে অনেক উপকরণ, যেমন- ভারী ক্যামেরা, বুম, সরাসরি সম্প্রচারের সরঞ্জাম এবং এগুলো পরিচালনার জন্য বাড়তি ক্রু বহন করতে হয়।
ফলে তিনি চাইলেই যখন ইচ্ছে তখনই সংবাদ দেওয়া শুরু করতে পারেন না। কিন্তু একজন মোবাইল জার্নালিস্টের এসবের বালাই নেই। তিনি ইচ্ছে করলেই একা কাজ করতে পারেন। সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য তাকে বিশাল ও জটিল আউটসাইড ব্রডকাস্টিং ভ্যান ব্যবহার করতে হয় না, বরং দ্রুতগতির ইন্টারনেট কানেকশন ব্যবহার করে তিনি শুধু তার ছোট্ট স্মার্টফোনটি দিয়েই দর্শকের উদ্দেশে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারেন। রিয়েল-টাইম সাংবাদিকতার জন্য বর্তমান বিশ্বে মোবাইল জার্নালিজম একটি অনন্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
একজন মোবাইল জার্নালিস্ট সহজে বহনযোগ্য অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন মোজো করার জন্য। যেমন ধরুন, ছবি তোলার জন্য তিনি স্মার্টফোনের বদলে ডিএসএলআর ক্যামেরাও ব্যবহার করতে পারেন, কারণ এই ক্যামেরা অনায়াসে যত্রতত্র ব্যবহার করা যায়।
তবে মোবাইল সাংবাদিকতায় মূলত প্রাইমারি ডিভাইস হিসেবে স্মার্টফোন ব্যবহার করা হয়। ছবি তোলা, ছবি এডিটিং, ভিডিও করা, মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া এসব কাজের জন্য আধুনিক স্মার্টফোনগুলো বেশ পারদর্শী। অবশ্য অনেক মোবাইল জার্নালিস্ট ল্যাপটপ ব্যবহার করেন তার সংবাদটি সম্পাদনা করার জন্য। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও মোবাইল জার্নালিজমের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে একটি স্মার্টফোন।
বলে রাখা ভালো, এবিষয়ে আমি কোনও এক্সপার্ট বা বিশেষজ্ঞ নই। পেশার খাতিরে নিরন্তর জানার চেষ্টা করছি মাত্র। লেখার প্রয়োজনে বিভিন্ন বই, পত্রিকা ও ব্লগ পড়েছি। এসব সেসবেরই যোগফল বা একত্রীকরণ।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।