নয়া মাধ্যমের নয়া দাপটে ম্রিয়মান দেশের টিভি চ্যানেল
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৮ জুন ২০২৪, ১৭:২১
চব্বিশ ঘণ্টা সম্প্রচারের একটি টিভিতে সাধারণত প্রতিদিন মোট আট থেকে দশ ঘণ্টার নতুন অনুষ্ঠানের যোগান দিতে হয়। এই দশ ঘণ্টার জন্য প্রতিদিন নতুন বিশটি অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। বাজেট ও কারিগরী বিবেচনায় প্রতিদিন মানসম্মত বিশটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করা চাট্টিখানি কথা নয়! তাই টিভিকে বলা হয় ক্ষুধার্ত মাধ্যম। অনেকে টেলিভিশনকে তলাবিহীন সমুদ্রের সাথে তুলনা করে থাকেন। একাডেমিকভাবে বলা হয় ‘ইরেজ মিডিয়া’।
বর্তমান প্রেক্ষিতে এমন ক্ষুধার্ত মাধ্যমের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন এতোগুলো মানসম্মত অনুষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে দর্শকদের চাহিদা বা পছন্দের কথা বিবেচনায় না এনে নিম্নমানের অনুষ্ঠান ও জোড়াতালির পুনঃপ্রচার দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানসূচি।
অধঃমূখীতার কারণগুলো হলো মানহীন অনুষ্ঠান সম্প্রচার, পুনঃপ্রচারের আধিক্য, স্বল্পবাজেটের রুচিহীন নাটকের আধিপত্য, বিবর্ণ পুরোনো বাংলা সিনেমা দিয়ে পর্দা দখল, মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, অতিমাত্রায় টকশো নির্ভরতা, যাচ্ছেতাই লাইভ শো প্রভৃতি। এই অবস্থা কিন্তু হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। দিনের পর দিন বেশিরভাগ মানহীন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ফলে দর্শক টিভির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরাও হাঁটছেন ভিন্নপথে। টিভিপর্দাকে আর অনুষ্ঠান নির্ভরতায় রাখা হচ্ছে না। টিভি চ্যানেলগুলোর মূল আধেয় এখন খবর। বিনোদন নির্ভরতা পরিহার করে বাংলাদেশের অধিকাংশ টিভি চ্যানেল এখন টকশো ও সংবাদপ্রধান হয়ে উঠেছে। বলা চলে খবরের পাশাপাশি কতিপয় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়।
বিদেশি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত কনটেন্টের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারছে না দেশীয় টিভি চ্যানেল। অসম প্রতিযোগিতায় দৌড়ে দর্শকহীন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ টিভি চ্যানেল। উদ্দেশ্যহীন যাত্রা ও সমন্বয়হীনতার কারণে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দর্শকদের মনে ঠাঁই করে নিতে পারছে না।
হাজারো বিনোদন দেখার জন্য দর্শক এখন টিভি ছেড়ে অনলাইনে বা স্মার্টফোনে সময় কাটাচ্ছে। ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগ প্রভৃতি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিডিয়া। এগুলোকে বলা হচ্ছে ‘নিউ মিডিয়া’। বর্তমানে এই ‘নিউ মিডিয়া’ গ্রাস করে চলেছে প্রচলিত গণমাধ্যমকে। আলাপ হতে পারে ‘নিউ মিডিয়া’ আসলে কী?
‘নিউ মিডিয়া’ মূলত অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বোঝানো হচ্ছে। মূলধারার মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন বা হালআমলের অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে অন্য যে মাধ্যমগুলো রয়েছে সেগুলোই ‘নিউ মিডিয়া’। ‘নিউ মিডিয়া’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফরমেটের দিক থেকে ডিজিটাল আর এবং ইন্টারনেট নির্ভর। যেমন- ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, ব্লগ প্রভৃতি।
প্রযুক্তির সুবিধা ও বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান দেখার আকর্ষণে দর্শক প্রথাগত টিভি মিডিয়া পরিহার করে ‘নিউ মিডিয়া’র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। খবর, নাটক, সিনেমা, প্রামাণ্যচিত্র, খেলাধুলা, রান্নাবান্নার অনুষ্ঠান যখন যা চাই পাওয়া যাচ্ছে ‘নিউ মিডিয়া’ শাখা-প্রশাখায়।
টেলিভিশনের লিনিয়ার সম্প্রচার পদ্ধতিতে কারণে অনুষ্ঠান দেখার জন্য দিনক্ষণের যে অপেক্ষা করতে হয়। অনলাইন বিনোদন মাধ্যমে সেই বাধ্যবাধকতা এখন আর নেই, এই প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচারের সময় বলতে কিছু নেই।
‘অনলাইন প্ল্যাটফর্ম’ ও ‘নিউ মিডিয়া’ অধুনা এই শব্দগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। সংবাদ, বিনোদন, কেনাকাটা, হোটেল বুকিং, টিকেট ক্রয়, গেইমস্ খেলা, সভা, সেমিনার, ক্লাস, পরীক্ষা, যোগাযোগ, আড্ডা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, অফিস আদালত প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই হচ্ছে অনলাইনে।
পরিবর্তিত এই অনলাইন ভিত্তিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভবিষ্যতে যেখান থেকে পেছিয়ে আসার আর সুযোগ থাকছে না। অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে মুক্তি পাচ্ছে চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক নাটক, মিউজিক ভিডিও, ই-বুক প্রভৃতি। প্রতিদিন হাজার হাজার ইউটিউবার আপলোড করছে নতুন নতুন কনটেন্ট।
ওভার দ্য টপ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অডিও-ভিডিওসহ নানা কনটেন্ট প্রচার বাড়ছে পৃথিবীব্যাপি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। ‘নিউ মিডিয়া’র দ্বিমুখী যোগাযোগের প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রতিদিন হচ্ছে হাজার হাজার লাইভ স্ট্রিমিং। ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব প্রভৃতি নয়া মাধ্যমের নয়া দাপটে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে আমাদের টিভি চ্যানেল।
টিভি খুললেই বিজ্ঞাপন, সবকিছুই যেন বিজ্ঞাপনের দখলে। অনুষ্ঠানের টাইটেলে বিজ্ঞাপন, সেটে বিজ্ঞাপন, খবরের শিরোনামে বিজ্ঞাপন, স্ক্রলে চলছে বিজ্ঞাপন, পর্দার ডানে বামে ডঙ্গলে ঝুলে থাকে বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন বিরতিতেও বিজ্ঞাপন। অনুষ্ঠানের স্পন্সর বা মিডিয়া পার্টনার হয়ে সেখানে বিজ্ঞাপন। খানিক বাদে বাদে আচমকা টিভি স্ক্রিণ ছোট হয়ে ইংরেজি এল বর্ণের আকৃতিতে সুপার ইম্পোজ হয়ে দেখা দেয় বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপনের চাপে কোথাও আর অনুষ্ঠান নেই। দর্শকেরা বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান বা সংবাদ দেখতে পান। অনুষ্ঠান যেন ইদের চাঁদ, উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়। টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপন যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অনেকে বলে থাকেন বিজ্ঞাপন টেলিভিশনের হৃৎপিণ্ড । কারণ হলো বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হলো বিজ্ঞাপন। যত বেশি বিজ্ঞাপন সময় বিক্রি হবে, আয় হবে ততে বেশি। টেলিভিশনের সারাদিনের প্রচার সময় থেকে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত থাকে।
প্রতিদিনের প্রচারসময় থেকে অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচারের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণের পাশাপাশি বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন সময় নির্ধারণ করা থাকে। এই বিজ্ঞাপনী সময় বিজ্ঞাপনদাতার কাছে বিক্রয় করা হয়। নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের প্রচারণার জন্য সময় ক্রয় করেন। নোম চমস্কির ভাষায়, ‘গণমাধ্যম বিজ্ঞাপনদাতার কাছে অডিয়েন্সেকে বিক্রি করে’।
বিশ্বব্যাপী এখন অনলাইন নির্ভর তথ্য ও বিনোদনের জয়জয়কার। আমাদের দেশেও বিস্ময়করভাবে বেড়েছে ‘নিউ মিডিয়া’ ব্যবহারকারী। অতি দ্রুত প্রযুক্তি বদলের ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রচারণায় কৌশল বদলে ফেলেছেন। প্রচারণায় চালাচ্ছেন অনলাইন প্লাটফর্মে। প্রচলিত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে বিজ্ঞাপন বুকিং কমিয়ে দিয়ে অনলাইন প্লাটফর্মে বাজেট বৃদ্ধি করছেন।
টিভি চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন বুকিং কমিয়ে দেয়ার ফলে টিভি স্টেশনগুলো পড়েছে আর্থিক সঙ্কটে। একসময় টিভিতে বিজ্ঞাপনের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বর্তমানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন বিভাজিত হওয়ায় সেই একচ্ছত্র আধিপত্য দাপট আর নেই বললেই চলে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অল্পটাকায় বিজ্ঞাপন সময় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। তাতে করেও কাঙ্খিত আয় হচ্ছে না। আয় কমে যাওয়ায় টিভি কর্তৃপক্ষ ভালো মানের অনুষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করছেন না।
তথাকথিত টিআরপি রেটিং তালিকার তলানীতে থাকা নাম আর শীর্ষে থাকা নামের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় তেমন কোনো হেরফের নেই। চ্যানেলের লোগো উঠিয়ে দিলে একটার সাথে অন্যটার পার্থক্য করা কঠিন। বিজ্ঞাপনদাতারা তাই এখন আর তথাকথিত টিআরপি মানছেন না। কৌশলে টিভি থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন বিজ্ঞাপন বাজেট।
বাজার বিশ্লেষণ করে জানা যায়- টিভি বিজ্ঞাপন থেকে প্রায় অর্ধেক বাজেট কমিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞাপনদাতারা। আর এসব বিজ্ঞাপন শিফট্ করেছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। তারা প্রযুক্তিগত যুক্তি দিয়েছেন। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় সে তুলনায় ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে অনেক বেশি সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতের বিজ্ঞাপন বাজার হবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। প্রথাগত টিভির প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে ইন্টারনেট বিপ্লব।
আশার কথা আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এখন অনলাইনে দেখা যাচ্ছে। প্রচারিত সব অনুষ্ঠান আপলোড করা হচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। অনলাইনে লাইভ স্ট্রিমিং করছে প্রায় সব টিভি। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল অনলাইনে দেখার জন্য ইতোমধ্যে নিজস্ব অ্যাপ তৈরি করছেন। নয়া মাধ্যমকে চ্যালেঞ্জ করে নির্মাণ করবে মানসম্মত সামসময়িক কনটেন্ট। প্রত্যাশা করা যায়- টেলিভিশন প্রচলিত ধারার বৃত্ত থেকে বাইরে এসে নয়া-দাপটে প্রতিযোগিতা করবে মুক্তবাজার।
বিটিভি ৬০ বছরে, ড. ইসলাম শফিকের লেখার চুম্বক অংশ
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।