সংবাদকর্মী অবশ্যই খাপখোলা তলোয়ার হবেন, তবে__
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১৪:৪৬
সালেহ বিপ্লব: তখন নতুন নতুন সংসদ ভবনে যাই। সচিবালয়ে যাই। মনে হতো বিশাল এক সমুদ্রে পড়েছি! ভবনগুলো বিশাল, শুধু তাই নয়। কাজের ক্ষেত্রটাও সমুদ্রসম। নিউজ করতে গিয়ে কোনটা বাদ পড়ে গেলো, কোনও ভুল করলাম কি না, এ নিয়ে অস্থির থাকতাম। ৯৬-৯৭ সালের কথা বলছি।
ভোরে পত্রিকা এলেই দ্রুত নিজের রিপোর্টগুলো দেখতাম। সাদাকালো হলেও দৈনিক রূপালী আমার কাছে সব সময় রঙিন, প্রথম কর্মস্থল, অমর প্রেম। রূপালী পড়তাম সবার আগে। বাসায় তখন কমপ্লিমেন্টরি কপি পেতাম ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, নিউ নেশন, আল আমীন আর দিনকাল। অফিস থেকে বিশেষ কাজের প্রয়োজনে জনকণ্ঠ দেয়া হতো, সেটার বিল বেতনের সঙ্গে পেয়ে যেতাম।
তো প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই নিজের পরীক্ষা নিতাম নিজেই। দেখতাম, আমি যে রিপোর্টটা করেছি, সেই একই রিপোর্ট অন্য পত্রিকায় তথ্য-উপাত্ত আর উপস্থাপনার গুণে ডিফরেন্ট হয়ে গেছে। ভাবতাম, কী করে আরো তথ্যবহুল ও সুপাঠ্য রিপোর্ট তৈরি করা যায়। কী করে এবং কবে বড়ো রিপোর্টার হবো? কিন্তু ছোট মাথায় কী আর সবকিছু ধরে? ধরে না। তাই প্রধানতম কৌশল গ্রহণ করলাম, সিনিয়রদের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকা।
আক্ষরিক অর্থে তাই করেছি অনেকগুলো বছর। সংসদ, সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় - যেসব বিটে কাজ করেছি, সিনিয়রদের সঙ্গ ছাড়িনি কখনো। এমনকি ঢাকার বাইরে ট্যুরে গেলে জেলায় সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে নিজে যেচে বন্ধুত্ব করেছি সেই সময়েই। আর এভাবে অগ্রজদের কাছে যে শিক্ষাটা পেয়েছি, তাই কাজে লেগেছে পরবর্তী বছরগুলোতে। এখনো কাজে লাগে। সেই সময়টাতেই চিনলাম নাজিমউদ্দিন মোস্তান ভাইকে।
সংবাদপত্রের পাঠক হিসেবে বিখ্যাত সব সাংবাদিককে ছোটবেলা থেকেই চিনি, মানে হলো, নামে চিনতাম। মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে সেই বিখ্যাতদের একে একে দেখছি, পরিচিত হচ্ছি! কী যে গর্ব হতো তাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসতে পেরে, মনে পড়লে এখনো ভালো লাগে। নাজিম উদ্দিন মোস্তান ভাইকে চিনলাম জাতীয় সংসদে গিয়ে।
সংসদ অধিবেশনে সাংবাদিকদের নেওয়ার জন্য সংসদ সচিবালয় থেকে বাস পাঠানো হয় জাতীয় প্রেসক্লাবে। বাস যখন সংসদে গিয়ে পৌঁছে, অধিবেশন শুরু হয় তার অনেক পরে। আমি করতাম কী, সিনিয়রদের সঙ্গে জনসংযোগ বিভাগে যেতাম। সাদেক ভাই (আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন) তখন জনসংযোগ পরিচালক। তার টিমে ছিলেন তারিক ভাই, লাবণ্য আপা, এনামুল ভাই। তাদের সঙ্গে দেখা করে তিন তলার ক্যাফেটেরিয়া।
এরপর বড়োরা যে যার মতো করে নিউজের ধান্দায় তাদের পরিচিত অফিসারদের চেম্বারে যেতেন, দু’একজন দু’এক সময় আমাকেও নিয়ে গেছেন, তবে সব সময় নিতেন না। আমি একা একা টুক টুক করে ঘুরে বেড়াতাম। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার অফিসে প্রতিদিন একবার যেতাম, যাতে আর কদিন বাদে তার স্টাফরা আমাকে চেহারা দেখলেই চিনতে পারেন। আইন শাখা, নোটিশ শাখা এবং যখন যেখানে সম্ভব চেহারা দেখাতাম। ভিজিটিং কার্ড দিতাম।
এরপর এসে বসতাম সাংবাদিক গ্যালারিতে। বসে থাকতাম আর দেখতাম। বিরতির সময়ও চা-নাস্তা খেয়ে আবার গ্যালারিতে চলে আসতাম। এমপিদের আসা যাওয়া, সংসদ কক্ষের সাজসজ্জা- এসব দেখতে দেখতে সময় পার হতো। এমন একদিন, সম্ভবত আসরের নামাজের বিরতি চলছিলো।
আমি যথারীতি এসির বরফঠাণ্ডা বাতাসের গতিপথ থেকে সরে বসে আছি গ্যালারিতে। পাশের চেয়ারে এসে বসলেন একজন দুবলা-পাতলা ভদ্রলোক। গোঁফগুলো দেখার মতো। সালামের জবাব নিয়ে আমার দিকে তাকালেন চশমার ওপর দিয়ে। বললেন, আজ আমার দেরি হয়ে গেছে। কাজ ছিলো, সেজন্য সংসদের বাসে আসতে পারিনি।
এরপর শুরু হলো ম্যারাথন প্রশ্ন। অধিবেশন কটায় শুরু হয়েছে? প্রশ্নোত্তর পর্বে কয়টা প্রশ্নের উত্তর মন্ত্রীরা সরাসরি দিয়েছেন? সম্পূরক প্রশ্ন কী ছিলো? কে কে সম্পূরক করেছেন? প্রধানমন্ত্রী কখন এসেছেন? তিনি কী রঙের শাড়ি পড়েছেন? মনমেজাজ কেমন দেখলেন? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন।
ভদ্রলোক খুব সফটস্পোকেন। ভালো লাগলো। তিনি প্রশ্ন করছেন, আমি বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিচ্ছি, তিনি নোট নিচ্ছেন। অন্তত দশ মিনিট তিনি প্রশ্ন করে কাটালেন। তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন, তখনো অধিবেশনের বিরতি শেষ হয়নি। আমি যথারীতি বসে বসে দেখার কাজ করছি।
একটু পর সবাই চলে এলেন গ্যালারিতে, সেই ভদ্রলোকও। গেলাম আশিস দাদার (আশিস সৈকত) কাছে। চুপিচুপি হাত ইশারায় দেখিয়ে জানতে চাইলাম, ওই ভদ্রলোক কে? আশিসদা জানালেন, তিনি ইত্তেফাকের নাজিম উদ্দিন মোস্তান। বাড়ি কিন্তু আপনার জেলায়। মোস্তান ভাই সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানালেন।
সেদিন আমি শিখলাম, কীভাবে একটা রিপোর্টে কয়েকটি মাত্র শব্দে বিশেষ তথ্য সন্নিবেশ করা যায়। হোক সেটা বাক্যালংকার কিন্তু তথ্য হিসেবে ফেলনা নয়। মোস্তান ভাই যখন জানতে চাইলেন, প্রধানমন্ত্রী কী রঙের শাড়ি পড়েছেন, তখনই বিষয়টা মাথায় গেঁথে নিলাম।
যাকে আমরা হার্ড রিপোর্ট বলি, সেই হার্ড রিপোর্টেও যে পারিপার্শ্বিকতা তুলে আনা যায় এবং শব্দের অপচয় না করেই তা করা সম্ভব, এটা আমি নাজিম উদ্দিন মোস্তান ভাইর কাছে শিখেছি।
মোস্তান ভাইর মতো আইকনদের কাছে আরও কিছু শিখতে পারলে ভালো লাগতো। মোস্তান ভাই ইত্তেফাক ছাড়েন ১৯৯৮ সালে। এরপর তেমন এটা দেখা হতো না। রাষ্ট্র নামের একটা পত্রিকা বের করতেন, সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। মাঠে দেখা হতো না আগের মতো। মারা গেলেন ২০১৩ সালের আগস্টে। ২০০৩ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। তিনি যে কতো বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন, কতো বড়ো একজন সাংবাদিক ছিলেন, আলাপ না করলে বোঝা যেতো না।
সিনিয়রদের কাছে যা শিখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, রিপোর্টার অবশ্যই একটু উদ্ধত হবেন, তবে বেয়াদব না। সাংবাদিক অবশ্যই একটু মুডি হবেন, তবে চাঁড়াল না। সংবাদকর্মী অবশ্যই খাপখোলা তলোয়ার হবেন, তবে বিনা প্রয়োজনে কাউকে কাটবেন না। সূত্র: আমাদেরসময়.কম
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।