ছেলেকে আত্মসমর্পণের আহ্বান
ছেলেকে জঙ্গিবাদে ঠেলে দিয়ে হতবিহ্বল মা এমিলি
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১০ নভেম্বর ২০২২, ০৭:৫৩
জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান (১৫) আট মাস ঘরের বাইরে। দীর্ঘ সময় ধরে সন্তানের দেখা না পেয়ে হতবিহবল মা আম্বিয়া সুলতানা এমিলি।
বুধবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে রিয়াসাদ রাইয়ানের মা জানান, চরম ভুল একটি পথকে সঠিক মনে করে তিনি এবং তার সন্তান এগোচ্ছিলো। এ কারণেই হয়তো সন্তান তার বুক খালি করে বান্দরবানের পাহাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায় পরে আছে। তিনি জানেন না সে জীবিত না মৃত। এই সিদ্ধান্তকে একজন মা হিসাবে চরম ব্যর্থতা বলে মনে করেন তিনি।
ছেলের শিক্ষকের মাধ্যমে তিনি নিজেও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন। বলেন, তাকে এবং তার সন্তানকে ডি-মোটিভেটেড করা হয়েছে, ভুল পথ দেখানো হয়েছে। জঙ্গিদের নাম, সংগঠনের নাম সবকিছুই তার কাছে গোপন করা হয়েছিলো। তার নিকট সবকিছু কোরআন-হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, তার নবম শ্রেণী পড়ুয়া সন্তান ছিল অত্যন্ত মেধাবী, বিনয়ী এবং ভদ্র। জঙ্গিরা তার সন্তানের মতো বিনয়ী এবং মেধাবীদেরকেই বাছাই করে বাধ্য করছেন এই কাজগুলো করার জন্য। র্যাব তার সাথে যোগাযোগ করে সবকিছু বুঝিয়ে বলায় তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। সেই সঙ্গে জেনেছেন জঙ্গিরা দেশের জন্য কতোটা ভয়ঙ্কর।
এমিলি জানান, ছেলের শিক্ষক আল-আমিন তাদের কাছে অনেক বিশ্বস্ত ছিল। তিনিই (আল-আমিন) তাদের মা-ছেলেকে কোরআন-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ডি-মোটিভেটেড করে। শুরুতে বাঁধা দিলেও সন্তানের জেদ এবং আল-আমিনের কথার কাছে হেরে যান তিনি। তার স্বামীর অবস্থা এখন আশংকাজনক। তিনি তার সন্তানকে ফেরত চেয়েছে এবং আত্মসমর্পণ করে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি দেশের সকল অভিভাবকদের সচেতন হতে বলেছেন।
মা হিসেবে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে সবার উদ্দেশে এমিলি বলেন, ‘আমি শিক্ষিত মা হিসেবে অনুরোধ করছি, বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে সময় দেবেন, বুকে জড়িয়ে ধরবেন, ভেতরটা জানার চেষ্টা করবেন। ভালোবাসবেন। প্রতিদিন জানবেন। তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবহেলা করবেন না। সে ছিটকে যেতে পারে যেকোনও সময়। তখন আমার মতো বুক ভাসিয়ে আর কোনও লাভ হবে না। সন্তানের মনটা বুঝুন। মা-বাবা যখন সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে তখন সব কিছু শেয়ার করে, কাছে যেতে পারে। সন্তান হিসেবে অসহায় বোধ করবে না। বিপথে চলে যাবে না। সব বাবা-মাকে বলছি, সংশোধন হোন, নইলে নিজেও ধ্বংস হয়ে যাবেন, জাতিও ধ্বংস হয়ে যাবে।’
এমিলি বলেছেন, আমি দেশবাসীর উদ্দেশে বলতে চাই, আমি যে ভুল করেছি, আমার বুকটা যেভাবে খালি হয়েছে, সেই একই ভুল যেন কোনও বাবা-মা না করেন। আমি শিক্ষিত মেয়ে হয়েও শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার পরিবার, সমাজের কাছে প্রকাশ করতে পারি না। আমার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। আমার খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বলতে চাই, আব্বু... যদি তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়ে থাকো। তুমি চরম একটা ভুল পথে আছ। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনও তোমার এই মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনও ধরনের হুমকির কাজ করবে না, কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা, অন্যায় কাজে শামিল হবে না। আমি অনুরোধ করছি, তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবে।
জঙ্গিবাদে জড়ানো সন্তানকে উদ্দেশ করে মা এমিলি বলেন, তোমার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেছে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি, যদি তার কিছু হয়ে যায়। তোমার নানা-নানি সবার অবস্থা খারাপ। তোমার কাক্কু, আত্মীয়স্বজন সবাই পাগলপ্রায়। আমার মা হিসেবে, তোমার বাবার জন্য চরম ব্যর্থতা হবে যদি তুমি বিশৃঙ্খলা করো, নৃশংস কিছু করো। তুমি তোমার বাবা-মাকে অপমানিত কোরো না। এই দেশে জন্ম নিয়ে তুমি অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছ।
আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ করছি, আমাদের ছোট সন্তানরা পাহাড়ে দিনের পর দিন না খেয়ে কীভাবে আছে? ওরা তো ঘরেই ছিল, মায়ের বুকে ছিল। ওরা ওখানে কীভাবে বাঁচবে। ওরা নিজেও জানে না কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদের ফিরিয়ে আনুন, ওদের সুযোগ দিন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, মায়ের বুকে ফিরে আসার। ওদের উদ্ধার করুন।
বিভিন্ন সময়ে নিরুদ্দেশ তরুণদের বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা নজরদারি করতে গিয়ে তথ্য পায় যে, নারায়ণগঞ্জ থেকে আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান নামে এক তরুণ গত মার্চ মাসে নিরুদ্দেশ হয়। তার পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডি করে। এরআগে, প্রকাশিত নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকায় আবু বক্করের নাম রয়েছে।
গত ৩ নভেম্বরের অভিযানে র্যাব ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামক সংগঠনের মহিলা শাখা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় এবং জানতে পারে যে, একজন মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তার সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে পাঠিয়েছেন।
র্যাব তথ্য বিশ্লেষণ ও নজরদারির মাধ্যমে নিজ সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে গত ৫ নভেম্বর উদ্ধার করে। এরপর তাকে পরিবারের কাছে রেখে গত ৪ দিন ধরে ডি-রেডিকালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখে।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।