কারাবাসের অভিজ্ঞতা জানালেন ডা. সাবরিনা

কয়েদিরা আদর করে আমাকে ৪ আঙুল বেশি জায়গা দিতেন

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারী ২০২৪, ১৬:০০

ছবি: সংগৃহীত

তিনি বাংলাদেশের অন্যতম নারী কার্ডিয়াক সার্জন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। পাশাপাশি ছিলেন জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান। করোনা পরীক্ষার টেস্ট না করেই দিতেন রিপোর্ট ডেলিভারি। টেলিভিশনেও পরিচিত মুখ। বলছি ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর কথা। সব খবর ছাপিয়ে আবারও শিরোনামে এলেন তিনি।

শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) গণমাধ্যমে কারাবাসের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন সমালোচিত এই চিকিৎসক। তিনি জানান, পুরোনো কয়েদিরা আদর করে তাকে চার আঙুল বেশি জায়গা দিতেন। 

ডা. সাবরিনা বলেন, হাজতি হিসেবে আগে অভিজ্ঞতা থাকলেও কয়েদি হিসেবে অভিজ্ঞতা হয়েছে। শ্রেণিপ্রাপ্ত, ডিভিশন এবং নর্মাল ওয়ার্ডের আসামি হিসেবেও থেকেছি। নরমাল ওয়ার্ডে ২৫ থেকে ৪৭ জন আসামি থাকতাম। সবাইকে ঘুমানোর জন্য জন্য দুটো কম্বল দেওয়া হত, আর সবার জন্য মুঠো হাত জায়গা বরাদ্দ ছিল। ‘বিসিএস ক্যাডার’ বলে আদর করে সবাই আমাকে চার আঙুল বেশি জায়গা দিতেন।

তিনি বলেন, কারাগারের লাইব্রেরিতে অনেক বই পড়েছি। তখন থেকে বই লেখার ভাবনা আসে মাথায়। আগে নিভৃতে বই লিখলেও পরে ভাবলাম আমাকে বই লিখতেই হবে। আসন্ন একুশে বই মেলায় আমার একটা বই পাওয়া যাবে। এই বইয়ে নিজের কোনো ঘটনা নেই, এখানে স্থান পেয়েছে নারীবন্দিদের লোমহর্ষক সব ঘটনা।

ডা. সাবরিনা বলেন, আমি কারাগারে ফুল ফুটিয়ে এসেছি এটুকু বলতে পারি। কারণ কারাগারে আমি মালির কাজ করতাম। ফুল বাগানের দায়িত্বে আমি ছিলাম। ওই সময়ে কারাগারে ফুলের বাগান ছিল না। ফুলের চারাগুলো কর্তৃপক্ষ আমাকে এনে দিয়েছেন কিন্তু মাটি কোপানো, গাছে পানি দেওয়া থেকে সবই করেছি। গাছে পানি দেওয়া মানে কোন পাইপ দিয়ে পানি দেওয়া নয়, অনেক দূর থেকে পাত্রে করে পানি এনে গাছে দেওয়া হয়। দিনে দু’বেলা করা হয়। খুবই কঠিন মাটি, সেই মাটিতে আমি ফুল ফুটিয়ে এসেছি।

স্বামী আরিফুলকে নিয়ে তিনি বলেন, আমার স্বামী তো এখনও জেলেই আছে। তিনি আমার একমাস আগে থেকেই কারাবন্দি ছিলেন। সে আমার জন্য এখন মৃত। আমি নিজেকে বিধবা মনে করি।

এর আগে, ২০২০ সালের ২৩ জুন করোনার ভুয়া সনদ দেওয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে ডা. সাবরিনাসহ আরও ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। নিম্ন আদালতে তার সাজা হলেও উচ্চ আদালতে আপিল আবেদন করে জামিন পান তিনি। প্রায় তিন বছর কারাগারে কাটিয়ে গত বছরের ৫ জুন জামিনে মুক্তি পান সাবরিনা।

এই মামলায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক লিয়াকত আলী। এরপর একই বছরের ২০ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত।

২০২২ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর মুখ্য হাকিম তোফাজ্জল হোসেন এ ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী প্রতিষ্ঠানের সিইও আরিফুল চৌধুরীসহ আটজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেন।

রায়ে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রত্যেককে তিন বছর কারাদণ্ড ও তিন হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড, দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারায় প্রত্যেককে চার বছর কারাদণ্ড ও চার হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে চার মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪৭১ ধারায় প্রত্যেককে চার বছর কারাদণ্ড ও চার হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও চার মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই ১৫ হাজার ৪৬০ টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করে জেকেজি হেলথকেয়ার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরিফের চতুর্থ স্ত্রী সাবরিনা। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্যজন লন্ডনে। আরেকজনের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

দিনাজপুরের মেয়ে ডা. সাবরিনা। বেড়ে ওঠেন ঢাকার শ্যামলীর পিসি কালচার রোডের নিজস্ব বাড়িতে। মাঝে বেশ কিছুদিন পরিবারের সঙ্গে দেশের বাইরে থাকার কারণে পাশ্চাত্য জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।

১৯৯৩ সালে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন সাবরিনা। এরপর এমবিবিএস পাস করেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে। এই কলেজে থাকাকালেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এই প্রতারক চিকিৎসক। ছাত্রাবস্থাতেই বিয়ে করে ফেলেন সহপাঠীকে। তবে বেশি দিন টেকেনি সেই বিয়ে।

বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বেশ কিছুদিন একা থাকেন সাবরিনা। পরবর্তী সময়ে তিনি বিয়ে করেন এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে। সিই ঘরে সাবরিনার দুই সন্তান রয়েছে। কিন্তু সেই সংসারও বেশিদিন টেকেনি।

২০১৬ সালে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন গণমাধ্যমে। সেখানে বলেছিলেন নিজের মনের অজানা অনেক কথা। বলেছিলেন চিত্রনায়িকা হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়েছেন চিকিৎসক।

সেই সময় ডা. সাবরিনা বলেন, আমি নায়িকাও হতে চেয়েছিলাম একসময়। হা হা হা। তবে বাবার কড়া শাসনের কারণে আর সেটি হয়ে ওঠেনি। নায়িকা হওয়ার জন্য প্রস্তাবও পেয়েছিলাম। লুকিয়ে অভিনয়ের রিহার্সেলে যেতাম। তবে যেদিন ফাইনাল শুটিং হবে সেদিন বাবা বুঝে গেলেন সবকিছু। আমার আর অভিনয় করা হলো না।

তবে এবার আইনজীবী হতে ল কলেজে ভর্তি হয়েছেন সাবরিনা শারমিন হোসেন। ঠিক কোন কলেজে ভর্তি হয়েছেন, সে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। আইনজীবী হয়ে তিনি আইন বিষয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান।

ডাক্তার সাবরিনা বলেন, একটা সময় আমি ভাবতাম, মানুষের জীবনটা বেশি জরুরি। তখন আমি মেডিকেলে পড়েছিলাম। কিন্তু একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমার মনে হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবনের চাইতে মানুষের মান-সম্মানটা অনেক বেশি জরুরি।

এরপর তিনি বলেন, এলএলবি পাশ করে বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিয়ে আমার অ্যাডভোকেট হওয়ার ইচ্ছা। এমন মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা, যারা আইন সম্পর্কে নিতান্তই কম বোঝে এবং বিনা অপরাধে দিনের পর দিন জেল খাটছে।




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top