ভ্যানে লাশের স্তূপের ভাইরাল ভিডিওটি আশুলিয়ার
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:২০
একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভ্যানের ওপর কয়েকটি মরদেহের স্তূপ ঢেকে রাখা হয়েছে জীর্ণ একটি চাদর দিয়ে। লাশের স্তূপ ঢাকা দেওয়া চাদরের পাশ দিয়ে ঝুলে আছে নিহত দুজনের হাত ও পা। পুলিশের হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা দুই ব্যক্তি আরও একটি মরদেহ চ্যাং-দোলা করে ভ্যানের ওপর ছুঁড়ে মারেন।
এ সময় আশপাশে পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজনকেও দেখা যায়। ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিডিওটির ঘটনাস্থল ঢাকার আশুলিয়ার বাইপাইলে আশুলিয়া থানা সংলগ্ন এলাকায় এবং ঘটনাটি গত ৫ আগস্ট বিকেলের।
গতকাল শনিবার আশুলিয়া থানাসংলগ্ন এলাকায় গিয়ে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর দৃশ্যের ঘটনাস্থলটি যে আশুলিয়া থানা লাগোয়া তার প্রমাণ মেলে। আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের পেছনের সড়ক দিয়ে থানার দিকে যাওয়ার পথে ডান পাশের দেয়ালটি হুবহু ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যায়।
মহাসড়ক থেকে থানার দিকে অগ্রসর হয়ে এসবি অফিসের দিকে চৌরাস্তায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এলাকার লোকজন নিশ্চিত করেন, ঘটনাস্থল থানার সামনের সড়কে। ভ্যানে লাশের স্তূপের ওই দৃশ্য আশুলিয়া থানা ভবনের সামনের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে ধারণ করা বলে অনেকেই অনুমান করছেন। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, পরে ভ্যানটি থানার সামনে এনে লাশগুলো পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেওয়া হয়।
আশুলিয়া থানার সামনে ওইদিন প্রাণ হারানোদের মধ্যে ছিল মধ্য জামগড়া এলাকার শাহিন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আসশাবুর। তার বড় ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার পাশেই রাস্তায় পড়ে ছিল। পরে পুলিশ তার নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পিকআপে ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। ভাইটি আমার জীবিত ছিল নাকি মৃত সেটা জানার সুযোগও আমাদের হয়নি। আমার ভাইয়ের গায়ে নীল গেঞ্জি ছিল। আমরা গেঞ্জি দেখে পোড়া লাশ শনাক্ত করি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ বলেন, ‘ভিডিওটি আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম সেটি নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ভিডিওতে দেখতে পাওয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের অনেকে চিনেছেন বলে আমাদের তথ্য দিচ্ছেন। আমরাও বিষয়টি নিশ্চিত হতে কাজ করছি।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের ওই ভিডিও ক্লিপের প্রথম ২০ সেকেন্ড একজনকে সড়কে রক্তাক্ত ও নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর পাশেই একটি ভ্যানে একাধিক মরদেহ স্তূপ করে রাখা অবস্থায় দেখা যায়। একটি মরদেহের মুখ রক্ত মাখা দেখা যায়। দুটি মরদেহের হাত ছিল দুদিকে ছড়িয়ে রাখা। মরদেহগুলো বিছানার চাদর সদৃশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা ছিল।
পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অস্ত্রধারী দুই পুলিশ সদস্য। ৩৫ সেকেন্ডের দিকে সড়কে পড়ে থাকা মরদেহটি চ্যাংদোলা করে ভ্যানে তুলতে দেখা যায় পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা দুই ব্যক্তিকে। ৫৬ সেকেন্ডের দিকে পাশ দিয়ে দুজনকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। ১ মিনিটের পরে আশপাশে আরও দুজনকে দেখা যায়, যাদের একজনের হাতে অস্ত্র ও আরেকজনের হাতে ছিল হেলমেট। ১ মিনিট ১৩ সেকেন্ডে দুই ব্যক্তি মরদেহগুলো একটি পিভিসি ব্যানার দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করে।
এর দুই সেকেন্ড পরই দুই ব্যক্তিকে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতে দেখা যায়। পাশে ভ্যানের ওপর স্তূপ করে রাখা ছিল মরদেহগুলো। ১ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের দিকে ভ্যানটির পাশে পুলিশের পোশাক পরা ছয় থেকে সাতজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের পেছনে বালুর বস্তা দিয়ে তৈরি করা বাংকার। বাংকারের ঠিক পেছনে একটি হলুদ রঙের দেয়াল, নিচে কালো রঙ করা। দেয়ালের প্রায় ৩ ফুট ওপরে একটি পোস্টার সাঁটানো। পুলিশ সদস্যদের ওই সময় আশপাশে নজর রাখতে দেখা যায়। একজনকে মোবাইল ফোন কানে নিতেও দেখা যায়।
মূলত দেয়াল ও দেয়ালে সাঁটানো পোস্টারের সূত্র ধরেই গতকাল ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এটি আশুলিয়া থানাসংলগ্ন ‘ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেড অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টার’ এর সীমানা দেয়াল। ভিডিওতে যে পোস্টারটি দেখা যায়, সেটি যুবলীগের ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি ও ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেন ভূঁইয়ার। তবে বালুর বাংকার এরই মধ্যে সরিয়ে ফেলা হলেও দেয়ালে এখনো পোস্টারটি সাঁটানো রয়েছে।
থানার পাশের একাধিক দোকানি ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাওয়া দেয়াল, বালুর বস্তার বাংকার ও স্থানটি থানাসংলগ্ন বলে নিশ্চিত করেন। তারা জানান, গত ৫ আগস্ট সকাল থেকেই নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিক্ষোভকারীরা।
এরই মধ্যে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবরে আন্দোলনকারীরা থানার চারপাশ ঘিরে ফেলে। এ সময় থানার ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা মসজিদের মাইক ও হ্যান্ডমাইকে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। কিন্তু তারপরও বিক্ষোভকারীরা থানার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন পুলিশ গুলি চালাতে থাকে। আশুলিয়া থানার একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কেউ মুখ খোলেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিকেল ৪টার দিকে থানায় হামলার চেষ্টা করে আন্দোলনকারীরা। এ সময় পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন তিনি। তবে ভ্যানে লাশ স্তূপ করার ঘটনাটি তিনি দেখেননি।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে ভ্যানে মরদেহের স্তূপের পাশে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজনের পরিচয় ইতিমধ্যে শনাক্ত করা গেছে। তিনি হলেন ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালে। প্রায় দুই বছর আগে ঢাকা জেলার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন আরাফাত। ঢাকা জেলা উত্তর ডিবির ওসি রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব ওই পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘সেদিন ঢাকা জেলা পুলিশের এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহিল কাফী স্যারের নির্দেশে আমরা আশুলিয়ায় ছিলাম। আল্লাহর রহমতে ৫ আগস্ট আমরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলাম। নইলে আমাদেরও মরতে হতো।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পুলিশ কর্মকর্তা আরাফাত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সরকারি মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত ১৫ জুলাই রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে গুলি চালায় পুলিশ।
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা কর্মসূচি ঘিরে গত ৪ আগস্ট ঢাকাসহ সারাদেশে সরকার সমর্থিত নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েক শতাধিক নিহতের খবর পাওয়া যায়। এ অবস্থায় গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করে ভারত চলে যান। এমপি মন্ত্রীদের কেউ বিদেশ পালিয়ে গেছেন, কেউ দেশের আত্মগোপনে রয়েছেন আবার কেউ গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে আছেন। সূত্র: দেশ রূপান্তর
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।