গণভবন ছাড়তে মাত্র ৫ মিনিট সময় পেয়েছিল এসএসএফ

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:৩৮

ছবি: সংগৃহীত

৫ আগস্ট কোটা আন্দোলনের জেরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে চলে যান শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরপরই সেদিন বিকালে হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়ে। তখন প্রাণরক্ষার জন্য পালাতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় ছিল গণভবনের প্রহরায় থাকা বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (এসএসএফ) সদস্যদের।

গণভবনের বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্টিক্যাল গিয়ার, অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম, বেতার যোগাযোগ ও অপারেশনাল সরঞ্জামাদির মজুত ছিল এসএসএফের। কিন্তু, হাতে সময় একদমই না থাকায়, এসব ফেলে শুধু নিজেদের সঙ্গে থাকা ছোট আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিভিন্নভাবে গণভবন থেকে সংসদ ভবনে গিয়ে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেন তারা।

জনতা যখন সংসদ ভবনেও ঢুকে পড়ে, তখন এসএসএফ সদস্যরা দ্রুত নিজেদের অস্ত্র ও পোশাক খুলে সংসদ ভবনের ভল্টে রেখে সাধারণ পোশাকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে প্রাণরক্ষা করেন। পরবর্তীতে পরিদর্শন করে গণভবন ও সংসদ ভবনে থাকা ভল্টগুলো আর পাওয়া যায়নি, যা আন্দোলনকারী বেশে দুষ্কৃতিকারীরা নিয়ে গেছে বলে মনে করছে এসএসএফ।

আওয়ামী লীগ সরকারকে হটানোর জন্য আন্দোলনকারীদের জন্য সেটি ছিল এক বিজয়ের দিন, কিন্তু গণভবনে কর্তব্যরত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্যদের জন্য সেটি ছিল এক দুঃস্বপ্ন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পরপরই বিকেলে হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঝাঁপিয়ে পড়লে এসএসএফ সদস্যদের জীবন বাঁচাতে মাত্র ‘পাঁচ মিনিট’ সময় ছিল। খবর টিবিএস।

গণভবনে এসএসএফ সদস্যদের কৌশলগত সরঞ্জাম ছিল। হঠাৎ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে, তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ ছিল না বললেই চলে। ফলে, তারা সমস্ত সরঞ্জাম ফেলে রেখেই ছোটখাটো অস্ত্র নিয়ে পার্শ্ববর্তী সংসদ ভবনে আশ্রয় নেয়।

যখন জনতা সংসদ ভবনেও প্রবেশ করে, তখন এসএসএফ সদস্যরা দ্রুত তাদের অস্ত্র এবং ইউনিফর্ম খুলে ফেলে এবং ভবনের ভল্টে সেগুলো লুকিয়ে রাখে। নিজেদের রক্ষা করার জন্য, তারা সাধারণ পোশাক পরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে যায়।

পরবর্তীতে তদন্তে দেখা গেছে যে, গণভবন এবং সংসদ ভবনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার ভল্টগুলি খালি। এসএসএফ সন্দেহ করছে যে, আন্দোলনকারীদের ছদ্মবেশে দুষ্কৃতিকারীরা এগুলো চুরি করেছে।

এসএসএফ কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষতির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উন্নতমানের আক্রমণাত্মক রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, ড্রোন প্রতিরোধী ব্যবস্থা, ওয়্যারলেস যোগাযোগ ডিভাইস এবং বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদসহ ৫ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের কৌশলগত সরঞ্জাম সেদিন গণভবন এবং সংসদ ভবন থেকে লুট হয়েছে অথবা ধ্বংস করা হয়েছে।

অস্ত্র, গোলাবারুদ, অপারেশনাল সরঞ্জাম এবং এসএসএফের অন্যান্য সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের জন্য এসএসএফ তিনটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনগুলি ইতিমধ্যেই গণভবন এবং সংসদ ভবনের বর্তমান সামগ্রীর তালিকা পর্যালোচনা করেছে। তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল তিনটি প্রতিবেদনে সংকলিত করে এসএসএফ সদর দপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

এসএসএফ আনুমানিক ৫.২৮ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির হিসাব করেছে। এর মধ্যে ১১.৬২ লক্ষ টাকার অস্ত্র ও ম্যাগাজিন, ১১.৪৪ লক্ষ টাকার গোলাবারুদ ও গ্রেনেড, ২.৬৩ কোটি টাকার যোগাযোগ ও অপারেশনাল সরঞ্জাম, ১.৫৫ কোটি টাকার আইটি ও গোয়েন্দা সরঞ্জাম, ১৪ লক্ষ টাকার গাড়ি এবং ৭৪ লক্ষ টাকার অন্যান্য জিনিসপত্র রয়েছে।

প্রতিবেদনগুলি কি বলে?

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এসএসএফ উন্নত অস্ত্র ও গোলাবারুদ, হাই-টেক গাড়ি এবং অপারেশনাল ও যোগাযোগ সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এই সম্পদগুলি মূলত ভিআইপিদের বাসস্থান, অফিস এবং অন্যান্য স্থানে সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষিত থাকে।

এসএসএফ প্রতিবেদন অনুসারে, গণভবনের অপারেশন রুমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংরক্ষণের জন্য দুটি উন্নত ভল্ট ছিল, প্রতিটির ওজন ১০০ কেজি। একটি ভল্টে দুটি এসএমজি টি-৫৬ রাইফেল ছিল, অন্যটিতে ৯,৪৯৮ রাউন্ড গুলি ছিল।

প্রতিবেদনে ৫ আগস্টের ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে: ‘খন ছাত্রসহ আন্দোলনকারীরা গণভবনের গেট ভেঙে প্রাচীর টপকায়, তখন কর্তব্যরত ছয়জন এসএসএফ সদস্যের পালানোর জন্য মাত্র পাঁচ মিনিট সময় ছিল।’ ‘এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে, তারা তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং ওয়্যারলেস সরঞ্জাম ফেলে রেখে কাছের সংসদ ভবনে ফিরে যায়।’

এতে আরও বলা হয়েছে, ‘যখন আন্দোলনকারীরা সংসদ ভবনে প্রবেশ করে, তখন এসএসএফ সদস্যরা অপারেশন রুমের একটি ভল্টে ছয়টি পিস্তল এবং ২০০ রাউন্ড গুলি লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এবং জনতার সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য সাধারণ পোশাকে পরিবর্তন করে। ‘পরবর্তীতে তদন্তে দেখা গেছে যে, ভল্টটি খালি এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে।’

এছাড়াও, গণভবনের ছাদে দুটি ড্রোন প্রতিরোধী বন্দুক এবং একটি ড্রোন প্রতিরোধী ব্যবস্থা ছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সময় স্বল্পতার কারণে এসএসএফ সদস্যরা এই জিনিসপত্রগুলি সরাতে পারেনি। সকল ভিআইপি বাসভবন এবং সংসদ ভবনে নিরাপত্তা অভিযান পরিচালনার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ওয়্যারলেস সেট থাকে। তবে, এসএসএফ সদস্যরা এই ডিভাইসগুলিও উদ্ধার করতে পারেনি।

এসএসএফ এর সুপারিশ

এসএসএফ এই প্রতিবেদনগুলিতে হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধ করার জন্য, তারা এসএসএফ এর ভল্টগুলির নিরাপত্তার জন্য একটি পৃথক বোর্ড অফ অফিসার্স গঠনের পরামর্শ দিয়েছে।

এছাড়াও, এসএসএফ তাদের সমস্ত ওয়্যারলেস ডিভাইসের গোপনীয়তা কোড আপডেট করার মাধ্যমে একটি নতুন নেটওয়ার্কে যোগাযোগ সুরক্ষিত করার সুপারিশ করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত সরঞ্জাম এবং গাড়িগুলি মেরামত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

অপারেশনাল দক্ষতা আধুনিকীকরণ এবং বৃদ্ধির জন্য সংস্থাটি চলতি অর্থবছরে নতুন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সরঞ্জাম ক্রয়ের সুপারিশ করেছে এবং প্রয়োজন হলে অতিরিক্ত বাজেটের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। টিবিএস থেকে অনূদিত

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা ও সরকার ঘোষিত অন্যান্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসএসএফ অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ, অত্যাধুনিক যানবাহন, অপারেশনাল ও যোগাযোগ সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে থাকে। এগুলো মূলত ভিআইপিদের বাসভবন, কার্যালয় ও অন্যান্য স্থানে সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top