নতুন সিইসি ও ইসিদের শপথ কাল
রক্তের প্রতি দায় থেকে প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন মূল চ্যালেঞ্জ
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৪
নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য চার নির্বাচন কমিশনার (ইসি) শপথ নিতে যাচ্ছেন আগামীকাল রোববার। বেলা দেড়টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে তাদেরকে শপথ পাঠ করাবেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
শুধু ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানই নবনিযুক্ত এই কমিশনের প্রধান কর্তব্য নয়- একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার পাশাপাশি এই কমিশনের সামনে এবার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটি হলো জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে ঝরা রক্তের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে বৃহস্পতিবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। সিইসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন। আর নবনিযুক্ত চার জন নির্বাচন কমিশনার হলেন- সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল সানাউল্লাহ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার শুক্রবার ইত্তেফাককে বলেন, ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সততা ও সাহসের সঙ্গে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে নতুন কমিশনের সামনে।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ঝরে যাওয়া রক্তের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে এই কমিশন জাতিকে একটি প্রশংসিত নির্বাচন উপহার দেবে-এটাই মূল প্রত্যাশা। বিশেষ করে, নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ-যারা গত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি, তাদেরকে ভোটকেন্দ্রমুখী করার জন্য আস্থার পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনকে। অতীতের বদনাম ঘোচাতেও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে তাদেরকে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকারের সময়ে বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নিচ্ছে নাসির উদ্দীন কমিশন।
২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটাররা ছিলেন ভোটবিমুখ। তিনটি নির্বাচনই ছিল প্রায় একতরফা। দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এই তিন নির্বাচনের একটিও।
বিশেষ করে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় যাদের বয়স ১৮ বছর পেরিয়েছিল, যারা তখন প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছিলেন-তারা ভোট দিতে পারেননি বা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। সেই হিসাব কষলে বর্তমানে যাদের বয়স ন্যূনতম ২৮ বছর কিংবা এর থেকে কিছুটা বেশি-দেশের এই বিপুল সংখ্যক নতুন প্রজন্মের ভোটার সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চোখে দেখেননি।
পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আয়োজনের কারণে নির্বাচন ও রাজনীতির প্রতিই তারা আস্থা হারাতে বসেছিলেন। বলতে গেলে এই দীর্ঘ সময়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনের প্রতিই আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল দেশের নতুন-পুরোনো প্রজন্ম। এমন বাস্তবতায় বিপুল জনপ্রত্যাশা ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করছে নাসির উদ্দীন কমিশন।
গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী বে অব বেঙ্গল সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ১৭১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২৭ বছরের নিচে।
জুলাই- আগস্ট বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাগুলো এখনো সবার মনে সতেজ। এই আকাঙ্ক্ষা লাখো কণ্ঠের আওয়াজ, প্রায় পুরো জাতির আওয়াজ। যুবসমাজ পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। জুলাই বিপ্লবে ১ হাজার ৫০০ ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ২০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।
জুলাই-আগস্টে ঝরা রক্তের প্রতি যে নতুন নির্বাচন কমিশনের দায় রয়েছে, সেটি অবশ্য নবনিযুক্ত সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীনও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ২০১৪ সাল থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বিষয়ই ছিল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়। সেজন্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে ও সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাব।
নাসির উদ্দীন এ-ও বলেছেন, মানুষ যাতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনের জন্য মানুষ গুম- খুনের শিকার হয়েছে। এই ভোটাধিকার আদায় করতে গিয়ে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হাজার-হাজার মানুষ আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। অনেকে হাত, পা, চোখ হারালো! নিহত হলো কত মানুষ! তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না করতে পারি, তাহলে তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, ১৫ থেকে ১৭ বছর ধরে এ দেশের জনগণ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুদ্ধ করে চলেছে, এটা মনে রাখতে হবে। আমার মতে, এটাই নতুন নির্বাচন কমিশনের মূল চ্যালেঞ্জ। একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তারা আয়োজন করবেন-এটাই প্রত্যাশা।
বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় এই নেতা বলেন, দেশ থেকে নির্বাচন উঠে যাওয়ার কারণেই দানব সৃষ্টি হয়েছিল। নির্বাচনহীনতার কারণেই আগের সরকার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল। কারণ, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে হলে অন্যান্য অধিকারও কেড়ে নিতে হয়। বিগত সরকার এই কাজটিই করেছে। কারণ, বর্তমান সমস্যা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে-এর মূল সংকটটা কিন্তু নির্বাচনহীনতা। দেশে যখন জনগণের ভোটের অধিকার থাকে না, তখন সরকারের ও প্রশাসনের জবাবদিহিতাও থাকে না।
তিনি বলেন, নতুন প্রজন্ম দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে রয়েছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই নতুন নির্বাচন কমিশনকে কাজ করে যেতে হবে। আর একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারলে সেখান থেকেই জনপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আসতে শুরু করবে। সূত্র: ইত্তেফাক
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।