সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২

এভারকেয়ার হাসপাতালেই কি নির্ধারিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ?

ডেস্ক রিপোর্ট | ঢাকা | প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৫

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল আপাতদৃষ্টিতে একটি চিকিৎসালয় হলেও এই মুহূর্তে সেটিই যেন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল স্নায়ুকেন্দ্র। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)-এর ভারী কাচের দরজার ওপাশে ঝুলে আছে দেশের রাজনীতির অতীত, বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ।

হাসপাতালের বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা, গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় আর উৎকণ্ঠিত মানুষের অপেক্ষা—সব মিলিয়ে পুরো এলাকা থমথমে। এই ভবনের ভেতরেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়ছেন দেশের রাজনীতির দুই মেরুর দুই প্রতিনিধি।

একদিকে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ‘আপসহীন নেত্রী’ বেগম খালেদা জিয়া। অন্যদিকে রয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তরুণ মুখ, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদি। দুই প্রজন্মের দুই লড়াকু রাজনীতিকের এই সংকট যেন অদৃশ্য এক সুতোয় বেঁধে ফেলেছে গোটা দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র।

সিসিইউতে খালেদা জিয়া, ভেন্টিলেটরে জীবন-মৃত্যুর লড়াই

গত ২৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং বর্তমানে তিনি ইলেকটিভ ভেন্টিলেটরের সাপোর্টে রয়েছেন।

৭৯ বছর বয়সী এই প্রবীণ নেত্রী দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, কিডনি ও হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। গত ৫ ডিসেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি থাকলেও শেষ মুহূর্তে মেডিকেল বোর্ড দীর্ঘ ভ্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। বর্তমানে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তার চিকিৎসা চলছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেগম খালেদা জিয়া কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন—তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি প্রতীক। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এক-এগারো কিংবা টানা ১৫ বছরের দমন-পীড়নের মধ্যেও আপসহীন অবস্থান তাকে দলীয় সীমা ছাড়িয়ে জাতীয় অভিভাবকের আসনে বসিয়েছে। তার অসুস্থতা আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পুরো রাজনীতিতে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করেছে।

আইসিইউতে আরেক লড়াই: গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান বিন হাদি

একই হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন তরুণ রাজনীতিবিদ শরিফ ওসমান বিন হাদি। গত ১২ ডিসেম্বর, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার মাত্র ২৪ ঘণ্টা পর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মোটরসাইকেল আরোহী দুই দুর্বৃত্ত তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

শরিফ ওসমান বিন হাদি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের একজন সম্মুখসারির সংগঠক। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই তার ওপর এই হামলা দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

বিশেষজ্ঞদের মতে, হাদির ওপর হামলা কেবল ব্যক্তিগত কোনো ঘটনা নয়; এটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সহিংসতার একটি ভয়ংকর ইঙ্গিত। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় লুট হওয়া বিপুল অস্ত্র এখনো পুরোপুরি উদ্ধার না হওয়ায় নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেও সমালোচকদের মতে, এটি আগাম প্রতিরোধের ব্যর্থতারই প্রতিফলন।

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ও বাড়তি রাজনৈতিক উত্তাপ

এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে—আগামী ২৫ ডিসেম্বর দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে দেশে ফিরছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

মায়ের সংকটাপন্ন অবস্থা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কার মধ্যেই তার এই প্রত্যাবর্তন দেশের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। হাদির ওপর হামলাকে অনেকেই তারেক রহমানের জন্য একটি পরোক্ষ ‘বার্তা’ হিসেবেও দেখছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার রক্তাক্ত রাজনীতির ধারাবাহিকতা?

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বুলেট ও ব্যালট প্রায়শই পাশাপাশি চলে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তারই প্রমাণ। হাদির ওপর হামলা সেই রক্তাক্ত ধারাবাহিকতাকেই নতুন করে সামনে এনেছে।

এভারকেয়ারের দিকেই তাকিয়ে ১৭ কোটি মানুষ

আজ সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি এভারকেয়ার হাসপাতালের দিকে। এখান থেকে আসা প্রতিটি খবরই নির্ধারণ করতে পারে আগামী দিনের রাজনৈতিক গতিপথ।

বেগম খালেদা জিয়া কি সুস্থ হয়ে ফিরবেন?
শরিফ ওসমান বিন হাদি কি আবার রাজপথে দাঁড়াতে পারবেন?
নাকি কোনো দুঃসংবাদ পুরো দেশকে স্তব্ধ করে দেবে?

নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের সামনে এই অনিশ্চয়তা কাম্য না হলেও বাস্তবতা হলো—পুরো জাতি এখন এক অদৃশ্য সুতোয় ঝুলে আছে, যার এক প্রান্ত এভারকেয়ারের আইসিইউ-সিসিইউ, আর অন্য প্রান্ত অনাগত ভবিষ্যৎ।

 

সুত্র: বাংলানিউজ



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top