• ** জাতীয় ** আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা ** আবারও তিন দিনের ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি ** চুয়াডাঙ্গায় হিট স্ট্রোকে দুই নারীর মৃত্যু ** ইউআইইউ ক্যাম্পাসে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ নিয়ে তোলপাড় সারাদেশ ** সিলেটে মসজিদে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ইমামের মৃত্যু ** নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু ** সব ধরনের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন : https://www.newsflash71.com ** সব ধরনের ভিডিও দেখতে ভিজিট করুন : youtube.com/newsflash71 ** লাইক দিন নিউজফ্ল্যাশের ফেসবুক পেইজে : fb/newsflash71bd **


ফকির হওয়া সহজকর্ম নয়, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৪, ১৪:৪৩

ছবি: সংগৃহীত

‘ফকির’ বিশেষ্যটি শুনলে মানুষের মনে চিন্তাজগতের স্তর অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠে। বাংলার অপামার জনতা তাদের জীবনে বহু ফকিরের দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। এই ফকির নিয়ে লোকমুখে রয়েছে রঙবেরঙের নানান কথা। ফকির বলতে কেউ মনে করেন ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেওয়া ভিক্ষুকদের। অনেকে অজ্ঞতায়, অজ্ঞাতসারে এদের ফকির সম্বোধন করলেও, বস্তুত ‘ফকির’ বিশেষ্যটি অনেক উচ্চস্তরের মানবদের জন্য ব্যবহৃত হয়।

এই উপমহাদেশের মানুষ পীর-ফকির, সুফি দরবেশদের আদিকাল হতে সম্মানের চোখে দেখেন, যথাসাধ্য ভক্তি, শ্রদ্ধা করেন। ফকিরদের সংজ্ঞা ঠিক কী রকম হলে যথার্থতা লাভ করবে বলা মুশকিল, তবে মনে আসছে কোন এক বিখ্যাত সূফির অভিমত, ‘কোন সাধকের বাম কাঁধের ফেরেশতা যদি টানা ২০ বছর তাঁর আমলনামায় কোন গুনাহ লিখার সুযোগ না পায় তখনই সে ফকির হিসাবে সাব্যস্ত হবে’।

ফকির (বংশ)(গোষ্ঠী)(সম্প্রদায়)

মুসলমানদের এ পদবীটি এসেছে সন্ন্যাসবৃত্তি থেকে। মরমী সাধকরা ফকির পদবী গ্রহণ করতেন। এটি আরবি শব্দ, যার মূল অর্থ নি:স্ব। আবার আরবি ফকর শব্দের অর্থ দারিদ্র। এ থেকে ফকির শব্দের উৎপত্তি। ফকির এবং পার্শি দরবেশ ব্যক্তিগণ সাধারণত এদেশে ফকির নামে পরিচিত হন। বিশেষ কোন ধর্মমতের একান্ত অনুসারী না হয়ে যারা সকল ধর্মের মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করেন তাদেরকেও ফকির বলা হয়। আবার সুফি বা বাউল তত্ত্বের ধারকরাও ফকির নামে পরিচিত পেয়েছেন।

একসময় আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব দরবেশ খালি হাতে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে উপমহাদেশে (ভারতবর্ষে) এসেছিলেন লোকে তাদেরকে ফকির বলে সম্বোধন করতো। তারাও এই পদবী গ্রহণ করেছিলেন। 

ফকির শব্দটি মহান আল্লাহর জন্য মানুষের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনকে বোঝায়, যিনি একাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। মুসলিম বংশোদ্ভূত হলেও, এই শব্দটি ভারতে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে, মূলত গোস্বামীন, সাধু, ভিক্ষু এবং অন্যান্য উপাধির পরিবর্তে। ফকিরদের সাধারণত পবিত্র পুরুষ হিসাবে গণ্য করা হয়, যারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। মুসলমানদের মধ্যে ফকিরদের প্রধান সূফী হুকুম হল চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া এবং সোহরাওয়ার্দীয়া।

ফকির আরবি শব্দ, যার মূল মানে হলো সর্বহারা, যার কিছুই নেই এমন হতদরিদ্র। এর বহুবচন আরবিতে ফুকারা। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রেরণায় কিছু মানুষ সন্যাসী হয়ে যান, দুনিয়ার কোন ধনসম্পদ তাঁরা চান না। গরিবিয়ানায় তাদের কোনও গ্লানি নেই। মুসলমানের মাঝে সন্যাসী শব্দটা চালু নেই, বরং তাঁরা ফকির শব্দটি বেছে নেন, বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী গুরুরা যেভাবে নিজেকে ভিক্ষু বা ভিখারী হিসাবে পরিচয় দেন। পীর ও ফকির এমন ব্যক্তি হতে পারেন যিনি দুনিয়াদারি ছেড়ে দিয়েছেন, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে স্বেচ্ছায় দরিদ্রতাকে বেছে নিয়েছেন।

একজন ফকির হল ইসলামিক এবং দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্যে একজন ধর্মীয় তপস্বী বা পরোপকারী। ফকিররা তাদের চরম আত্মত্যাগ এবং তাদের বিশ্বাসের প্রতি ভক্তির জন্য পরিচিত। তারা একটি সরল এবং কঠোর জীবনযাপন করে। ফকিররা তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং মহান আল্লাহর প্রতি উৎসর্গের জন্য তাদের সম্প্রদায়ে সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয়। ফকির শব্দটি আরবি থেকে এসেছে এবং মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে পবিত্র পুরুষ এবং অতীন্দ্রিয়দের বর্ণনা করতে শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফকিররা প্রায়শই অলৌকিক কাজ এবং তাকওয়া প্রদর্শনের সাথে যুক্ত থাকে।

ফকির বলতে কাদের বুঝায়ঃ

এক সময় কোন এক ব্যাক্তি হুজুর গাউছে পাকের কাছে ফকির কাকে বলে জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, যিনি নফছানিয়ত খায়েশ ছেড়ে কেবল আল্লাহমুখি হয়েছেন এবং ফানা ফিশ শায়েখ, ফানাফির রাসুল, ফানাফিল্লাহর মকামে লাভ করেছেন তিনিই ফকির। ফকিরের আভিধানিক অর্থঃ দরিদ্র, গরিব, অভাবী, যার কিছুই নাই, এরা দুনিয়ার মুখাপেক্ষী নন।

কাশফুল মাহজুব কিতাবে দাতা গন্জে বখশ লাহোরী (কঃ) বলেন, যারা জাহেরী ধনসম্পদের সম্পর্ক ছিন্ন করে রব্বে তায়ালার রেজামন্দি হাসিল করেছেন তিনিই ফকির। 

ফকিরি সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ফকিরী আমার থেকে অর্থাৎ সকল ফকিরী আসে রাসুল (সা.) হতে। ফকিরী, দরবেশী আল্লাহর নিয়ামতের অন্যতম ভান্ডার। ফকির চুপচাপ থাকে, কিন্তু তার ক্বালব সদা আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকে। তার ক্বালব ঈমানী নূরে পূর্ণ থাকে।

এ ধরনের ফকির সম্পর্কে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, এমন অনেক লোক আছে যাদের মাথার চুল এলোমেলো, যারা মানুষের দুয়ার হতে বিতাড়িত। যদি তারা আল্লাহর নামে শপথ করে কিছু বলে ফেলে তা কবুল হয়ে যায় (মুসলিম শরীফ)। তারা একমুহুর্তও আল্লাহর জিকির হতে গাফেল হন না। মজ্জুব পর্যায়ের ওলীআল্লাহগণ এমনই হয়ে থাকেন।।

ফকিররা সাধারণত অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পবিত্র পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হন। মুসলমানদের মধ্যে ফকিরদের প্রধান সুফি তরিকা হল: মাদারিয়া শাদিলিয়াহ, চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া এবং সোহরাওয়ার্দিয়া।

ফকির (গোষ্ঠী) ইতিহাস এবং উৎপত্তিঃ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকেঃ

ফকির হল ভারতের একটি মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। ফকির [সৈয়দ] বা ফকির (আরবি : فقیر (ফকরের বিশেষ্য) শব্দটি ফকর (আরবি : فقر , দারিদ্র) থেকে এসেছে ফকির, শাহ, আলভি সৈয়দ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। তারা সৈয়দ বংশের সূফী সাধকদের বংশধর, আলীর কাছে পাওয়া যায়। এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার একজন মুসলিম সুফি তপস্বী এবং ফকিররা দরবেশদের ইসলাম শিক্ষা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

পশ্চিমবঙ্গের শাহজি ফকিরঃ

পশ্চিমবঙ্গের ফকিররা শাহজি নামেও পরিচিত। তারা শাহজি নামটি ধারণ করেছিলেন কারণ তারা একজন বিখ্যাত বাঙালি সুফি সাধক শের আলী শাহজির অনুসারী ছিলেন। বেশিরভাগ ফকির বিখ্যাত সুফি আব্দুল কাদির জিলানীকে তাদের পরামর্শদাতা বলে মনে করেন এবং বাংলার অধিকাংশ ফকির এইভাবে কাদরিয়া সুফি অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। একটি ছোট সংখ্যা চিশতী, মাদারিয়া, মোজাদিদি এবং নকশবন্দিয়া আদেশের অন্তর্গত।

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো, ফকিররা মূলত সুফিবাদীদের একটি সম্প্রদায় থেকে বিবর্তিত হয়েছে যা একটি অন্তঃবিবাহী জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এরা প্রধানত নদীয়া, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, বাঁকুড়া, বীরভূম এবং পুরুলিয়া জেলায় বাস করে। পশ্চিমবঙ্গের সিংহভাগ ফকিররা এখন চাষী, বহু বর্ণের গ্রামে বসবাস করে, তাদের নিজস্ব এলাকায় ফকির পাড়া নামে পরিচিত। তারা ধান, পাট, সরিষা ও তিলি চাষ করে। অল্প সংখ্যক ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকও রয়েছে।

ফকিররা বাংলায় কথা বলে এবং ইসলামের সুন্নি সম্প্রদায়কে অনুসরণ করে। কিন্তু তারা বেশ কিছু লোক বিশ্বাসের চর্চা করে, যাকে সম্মিলিতভাবে ফকিরমত বলা হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু সুফি সাধকদের বিশেষ শ্রদ্ধা জানানো জড়িত। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফকিরও রান্নার তেল উৎপাদনের সাথে জড়িত, এটি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবে তেলী জাতির সাথে জড়িত।

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকেঃ

ফকির একটি বিশেষ্য শব্দ, যার বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। নিঃস্ব, দারিদ্র্য, সর্বহারা যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের ফকির বলা হয়, আবার সংসারত্যাগী মুসলমান ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী বা সাধু পুরুষকেও ফকির বলা হয়।

ফকির বলতে বুঝানো হতে পারেঃ

ফকির (আরবি : الفقير) হল একটি ইসলামি পরিভাষা, যা ঐতিহ্যগতভাবে সে সকল সুফি মুসলিম তপস্বীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যারা তাদের পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করে এবং আল্লাহর উপাসনায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। তারা অগত্যা সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে এবং দারিদ্র্যের শপথ নেয়। তাদের কেউ বাস্তবে দরিদ্র হতে পারে এবং কেউ ধনীও হতে পারে, তবে অস্থায়ী পার্থিব জীবনের উপকরণসমূহ আল্লাহর প্রতি তাদের অবিচ্ছিন্ন উৎসর্গ থেকে বিরত হয় না।

তারা জিকিরের প্রতি যত্মবান ও শ্রদ্ধাশীল হয়। প্রাথমিকভাবে মুসলিম বিশ্বে সুফিবাদের আবির্ভাব হয় উমাইয়া খিলাফতের সময় (৬৬১-৭৫০) এবং এটি ইসলামের দুটি মূলধারা সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি রহস্যময় ঐতিহ্য হিসেবে বেড়ে ওঠে।

সুফি মুসলিম তপস্বীগণ (ফকির ও দরবেশ) ইসলামের ইতিহাসে ইসলাম প্রচারে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ব্যাপকভাবে সফল ছিলেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিমবিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চল উত্তর আফ্রিকা, বলকান, ককেশাস, ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তাদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সুফি মুসলমানরা দীর্ঘ একটি সহস্রাব্দ ধরে বিভিন্ন মহাদেশ ও সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আরবি, ফার্সি, তুর্কি, ভারতীয় ভাষাসহ বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ ভাষায় ইসলামের প্রচার ঘটিয়েছ।

সাম্পতিক ফকির শব্দটি এমন একজন সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যিনি পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করেন। এমনকি অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ফকিরদের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে এবং তাদের বিশেষ ঐশী শক্তির অধিকারী মনে করা হয়। শব্দটি প্রায়শই হিন্দু সন্ন্যাসীদের (যেমন: সাধু, গুরু,স্বামী ও যোগী) ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়। এই ব্যবহারগুলি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল যুগে বিকশিত হয়েছিল।

উত্তর ভারতে ফকিরদের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীও পাওয়া যায়, যারা সুফি মাজারে বসবাসকারী ফকিরদের সম্প্রদায় থেকে এসেছে। ১ম শিখ গুরু শ্রী গুরু নানক দেব জিও "নানক শাহ ফকির" নামে পরিচিত ছিলেন। মাওলানা মাজদ্দেদ্দিন আলী বাগের শাহ তার একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বলেন, "সুফি এমন একজন ব্যক্তি, যার আধ্যাত্মিক তপস্যার কারণে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে এবং যিনি তার আসল পরিচয় জেনেছেন। সুফিরা একেবারে দরিদ্র হয় এবং জীবনের সত্য ছাড়া আর কিছুই দেখে না।"

ফকির শব্দটির ব্যুৎপত্তিঃ

ব্যুৎপত্তিগতভাবে ফকির শব্দটি আরবি। এটি ফকর (আরবি: فقر) শব্দমূল থেকে এসেছে। এর অর্থ হল দরিদ্র হওয়া বা দুঃখী হওয়া। এ হিসেবে ফকির শব্দের বাংলায় অর্থ হয় দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত বা দুঃখী। বর্তমান বাংলা ভাষায় গরিব বা দরিদ্র বোঝাতেও ফকির শব্দ ব্যবহৃত হয়।

ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবি তালিবের (রা.) পুত্র এবং নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি হুসাইন ইবনল আলী তাসাউফের বিষয়ে মিরাত উল-আরফিন নামে একটি বই লিখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এটিকে সুফিবাদের উপর প্রথম বই বলা হয়। বিভিন্ন কারণে উমাইয়াদের শাসনামলে এই বইটি প্রকাশ করা যায়নি।

হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর পরে দীর্ঘকাল ধরে ফক্‌র, তাসাউউফ ও সুফিবাদের তথ্য ও শিক্ষা হৃদয় থেকে হৃদয়ে স্থানান্তরিত হতে থাকে। তবে এসব কথার কোনো শক্তিশালী ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। সে হিসেবে অনেক গবেষক এসব কথা মেনে নিতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন।

বাংলায় ফকির বলতে দুটি অর্থ প্রকাশ করে, যার একটি মূলত একজন সন্ন্যাসী, সাধু পুরুষ বা দরবেশকে বোঝায়। শব্দটি মুসলিম বংশোদ্ভূত হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এটি গোস্বামী, সাধু, ভিক্ষুক এবং অন্যান্য উপাধির মতো হিন্দু তপস্বী এবং রহস্যবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে।

ফকিররা সাধারণত অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পবিত্র পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হন। মুসলমানদের মধ্যে ফকিরদের প্রধান সুফি তরিকা হল:মাদারিয়া শাদিলিয়াহ, চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া এবং সোহরাওয়ার্দিয়া। কেমব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারী ফকির শব্দটিকে "ইসলাম ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য বা একজন পবিত্র মানুষ" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

লিখেছেন রাজীব রায়হান

ফকিরের গুণ নিয়ে পণ্ডিতদের মতঃ

একজন ফকিরের ঠিক কী গুণাবলী থাকতে হয় সে বিষয়ে অনেক মুসলিম পণ্ডিত মত দিয়েছেন। প্রথম দিকের বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আবদুল-কাদির জিলানি সুফিবাদ তাসাউউফ ও ফকরকে চূড়ান্তভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। একজন ফকিরের গুণাবলী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ফকির সে নয় যে কিছু করতে পারে না এবং তার আত্ম-সত্তায় কিছুই নেই। ফকিরের খোদাপ্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এবং তা তার থেকে প্রত্যাহার করা হয় না।

ইবনে আরাবী ফকিরসহ সূফীবাদকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি এই বিষয়ে ৫০০ টিরও বেশি বই লিখেছেন। তিনিই প্রথম মুসলিম পণ্ডিত যিনি খোলাখুলিভাবে ওয়াহদাত আল-ওজুদের ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন। তার লেখা এই বিষয়ে একটি জটিল উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়।

অন্য একজন প্রসিদ্ধ মুসলিম সাধক সুলতান বাহু একজন ফকিরকে ‘আল্লাহর কাছ থেকে পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্পণ করা হয়েছে‘ বলে বর্ণনা করেছেন। একই গ্রন্থে সুলতান বাহু বলেন, ফকির আল্লাহর একত্বে বিলীন হয়ে অনন্তকাল লাভ করে। সে যখন নিজেকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছ থেকে মুছে ফেলে, তখন তার আত্মা ঐশ্বরিকতায় পৌঁছে যায়।

ফকির শব্দের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণঃ

ফকির অতি সূক্ষ্ম শব্দ, আরবি হরফ (ফা, ক্বফ, ইয়া, র)- এই চার অক্ষরের (চারটি আরবি হরফ) সমন্বয় ফকির। এই চারটি হরফে আল্লাহর আটটি গুণবাচক বা বিশেষ শক্তির বহি:প্রকাশ বুঝায়। এই চারটি অক্ষরের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ -

(ফা) ফানা বা একান্ত ইচ্ছাশক্তি বা অনেকের মতে ফরজ বুঝায়। (ফা- ফানাফিল্লাহ) অর্থাৎ নিজেকে মহান আল্লাহর প্রেমে বিলিন করে দেওয়া ৷ নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর ফানা বা বিলীন করে দেয়া।

(ক্বাফ) কাস্ফ শক্তি অর্থাৎ আধ্যাত্মিক মহাশক্তি বুঝানো হয়েছে। কারণ এই কাফশক্তির ভেতর ছয়টি ভাবের অবস্থান পাওয়া যায়। কাফ অক্ষরটি আল্লাহ তায়ালা ছয়টি নামের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। ক্বফ- রবের ক্বাফশক্তিসমূহ (কাফ- কানাআত) কালব অর্থাৎ জিকির এর মাধ্যমে কালবকে জিন্দা রাখা ৷ ক্বাফ দ্বারা বুঝায় অন্তরকে আল্লাহর প্রেমে পরিশুদ্ধ করা, তার রেজামন্দির কাজে মগ্ন থাকা।

(ইয়া) নির্দিষ্টতা (ইয়া- ইয়াদেইলাহি) অর্থাৎ আল্লাহর ধ্যানে সর্বদা মগ্ন থাকা ৷ আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখে তার নিকট চাওয়া।

(র) রব বা রিয়াযত বোঝানো হয়। রাক্কাতে কালব অর্থাৎ আল্লাহর প্রেমরসে নিজেকে সর্বদা ডুবিয়ে রাখা ৷ র- দ্বারা আন্তরিক নম্রতা, কোমল চিত্ততা গ্রহণ করা বুঝায়। ‘র’ মানে বুঝানো হয়েছে, রেসালাত বা রেয়াজত করে প্রেম দিয়ে উপরে উঠিয়ে শুন্যে যাওয়া এবং পরিশেষে রসুলতত্ত্বের সাথে মিলিয়ে যাওয়া। 

হাকীকতের কাইউমিয়াতকে সৃষ্টির মধ্যে স্থায়িত্ব দান করবার জন্য ‘কাফ'। ‘কাফ' অক্ষর দ্বারা মহান আল্লাহর যে কয়টি নাম পবিত্র কোরআনে পাওয়া যায়, তার সবই শক্তিধর নাম। যথাঃ কাইউমুন, কুদ্দুসুন, কাবিউন, কাদিরুন, কাবিদুন, কাহ্ হারুন।

১। কাইউমুন- চিরস্থায়িত্বের শক্তি। স্থায়িত্ব নির্ধারিত করা হইল। ২। কুদ্দুসুন- দুর্বল ও অধঃপতিতকে উন্নত মর্যাদা দানকারী শক্তি। ৩। কাবিউন- চিরঞ্জীব শক্তির উৎস। ৪। কাদিরুন- শক্তিশালী, সৃষ্টিকে শক্তি দেওয়া হল। সুপরিমিত দানকারী শক্তি। ‘তকদীর' অর্থ ‘ভাগ্য' নয় বরং কর্মবৃত্ত দানকারী শক্তি। এই বৃত্ত সৃষ্টিজীব নিজ ক্ষমতায় বদলাতে পারে না। ভালো আমলের দ্বারা উহা কাদির শক্তির নির্ধারিত স্বাভাবিক নিয়মেই পরবর্তী কর্মবৃত্ত প্রাপ্ত হয়। বস্তুজগতের সীমা ডিঙ্গিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করা।

৫। কাবিদুন- নিয়ন্ত্রক, সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা হইল। ভাঙ্গন ক্রিয়ার শক্তি বর্ধিত করে সৃষ্টি হতে কোন কিছু নিশ্চিহ্ন করে ফেলার শক্তি সৃষ্টিকে দান করা হলো। আর এই সকল কাফ শক্তি অর্জন করার পরে সে হয় তখন মহান সাধক। ৬। কাহ্ হারুন- অপ্রতিহত ক্ষমতা। ধ্বংসকারী, যা ক্ষণস্থায়ী ও মিথ্যা, তা ধ্বংস করা হল। অর্থাৎ ‘যা নয়' তা ধ্বংস করা হল।

'ফক্বীর' আরবি শব্দ । এর আক্ষরিক অর্থ 'ফে' অর্থ ফানা, 'ক্বফ' অর্থ খোদায়ী শক্তি এবং 'রে' অর্থ রাজি থাকা। যাঁরা সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইমানের মধ্য তথা খোদায়ী শক্তির মধ্যে রাজি-খুশি থাকেন তাঁরাই ফক্বীর। এক কথায় যাঁরা শুধুমাত্র আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটান।

আভিধানিক অর্থ হলো তত্ত্বজ্ঞানী, খোদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তি, সরল মনের অধিকারী, শুভ চিন্তার ধারক-বাহক, কলন্দর, সৎ গুণসম্পন্ন ব্যক্তি, চারিত্রিক সৌন্দর্যের অধিকারী। ফারসি দরবেশ শব্দটি এর সমার্থক, তাই ফকির-দরবেশ জোড়া শব্দ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

ফকির অর্থ হলো অভাবী, যে দরজায় অপেক্ষমান থাকে। যারা মানুষের দরজায় অপেক্ষা করে তারা হলো ভিক্ষুক। আর সাধু পুরুষরা যেহেতু সদা আল্লাহর দরবারের দরজায় নিজেকে অপেক্ষমান রাখেন তাই তাদের ফকির নামে অভিহিত করা হয়। ফকিরের ক্রিয়ারূপ হলো ফকিরি।

কোরআনুল কারিমের ৪৭ নম্বর সূরা মুহাম্মদের ১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'ইয়া আইয়ুহান নাস! আন্তুমুল ফুকারাউ ইলাল্লাহ, ওয়াল্লাহু হুওয়াল গনিয়ুল হামিদ।' অর্থ-হে মানব সব, নিশ্চয়ই তোমরা সবাই আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী তথা ফকির (রিক্ত ও নিঃস্ব); আর আল্লাহ তায়ালাই হলেনএকমাত্র ধনী ও স্বনির্ভর এবং সদা প্রশংসিত।

ধর্মের বাহ্য আচারে তাদের আস্থা নেই। লোকদেখানো আন্দাজি পথ তাদের অপছন্দ। তারা আত্মমগ্ন উদাসীন ও আত্মতৃপ্ত। তাদের কিছুমাত্র ভোগসুখ বা ভালভাবে বাঁচার বাসনা নেই। উপাস্যকে তারা অন্তরে চায় বলে পার্থিব কিছু চায় না, অথচ বৈরাগীও নয়। চাহিদা নেই, প্রতিষ্ঠাকামী নয়, অথচ বিনীত, অকৃত্রিম ও অনাড়ম্বর। সবকিছু ত্যাগ করে তবে তো ফকির হওয়া যায়। আসল ফকিরি মতে বাহ্য আলাপ থাকে না, অর্থাৎ তার সবটাই অন্তর্জগতের ব্যাপার, ধ্যানময় ও নীরবতালব্ধ। এমনতর, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন ফকিরিপথও খুব নিষ্কন্টক নয়— কারণ চারপাশে বহুতর প্রতিকূল ও প্ররোচনা।

ধর্মনিষ্ঠা মোমিন মুসলমান চায় বেহেস্ত, হিন্দুরা চায় স্বর্গ। ফকির এর কোনওটাই কামনা করে না। সে চায় আত্মস্থ হতে। জপ ধ্যান জিকির তার কাম্য। কাম্য আল্লা। তাই তাঁর ধ্যানে সে ‘ফানা’ হতে চায়। হতে চায় দিওয়ানা। তার কাছে পার্থিব সবকিছু ম্লান, তাৎপর্যহীন, অসার। সবার অধম হয়ে দীনাতিদীন হয়ে খোলামেলা নিসর্গের মধ্যে তাদের উপাস্যসন্ধান।

নিজের শরীর-মন-সত্তাকে উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে গেলে পার্থিবভাবে ভারমুক্ত হতে হবে— অর্থাৎ বিষয়বৈভব সাজসজ্জা ত্যাগ করা দরকার। ফকিরিপন্থার সুচনাই হয়েছে একরকম দ্রোহ বা প্রতিবাদ থেকে। নির্জন সাহসে আড়ম্বরপূর্ণ, বিলাসপ্রিয়, ভোগাসক্ত জীবনের বিপরীত মেরুতে নম্র প্রতিবাদ।

‘জিক্‌র্‌’ অর্থাৎ জপ, ‘রাবিতা’ অর্থাৎ সংযোগসূত্র এবং ‘মুরাক্কিবহ্‌’ অর্থাৎ সতত জপ করার সঙ্গে সংসার অনাসক্ত মনকে শুদ্ধ করে রাবিতা অর্থাৎ সংযোগসূত্র বা গুরুর মাধ্যমে বিশুদ্ধ মনে শান্ত হয়ে আল্লার ধ্যান অর্থাৎ মুরাক্কিবহ্‌ করে আলোকময় পরমে (নূর) নিজেকে বিলীন করতে অহং লোপ হলো সবিশেষ জরুরি। অহং লুপ্ত ‘ফনা ফিল্‌লাহ্’ অবস্থাও শেষ নয়, সেই অবস্থার ভেতর শাশ্বত হয়ে থাকা অর্থাৎ ‘বক্কা বিল্‌লাহ্‌’ হল শেষ পরিণতি। 

সুফিদের রহস্যভাবনা, ধ্যান-জপ-অনুভবের একান্ত আত্মস্থ জগৎ। সেই আত্মস্থতা অর্জনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হল দেহ। দেহ মানে কামনাবাসনাবদ্ধ অস্তিত্ব, লোভে মোহে বন্দিসত্তা, আলস্যপ্রবণ, বিরামপ্রয়াসী, ভোগী আর ইহজগতের দাস। অথচ এই দেহকে ঘিরেই কায়াবাদীদের সাধনা। সুফিরা যে নিরন্তর জিকির আর মুরাকাবার সাহায্যে স্থিত হতে চান ‘ফানা’ স্তরে এবং তাকেই শাশ্বত করে হতে চান ‘বাকা’, তার জন্যে দেহের নিয়ন্ত্রণ দরকার। অর্জন করতে হয় দেহের ওপর মনের কর্তৃত্ব।

ফকিরিতন্ত্র— সুফিতত্ত্ব থেকেই সম্ভবত আত্মতত্ত্ব উদ্‌বোধনে ব্রতী হয়েছে। ফকিরদের স্বরূপ তথা ফকিরিয়ানা বুঝতে গেলে ইসলাম বুঝতে হবে প্রথমে, তারপরে অনুধাবন করতে হবে সুফিতত্ত্ব।

দরবেশের প্রতিশব্দ রূপে নানাভাবে নানা শব্দ এসেছে। ফকির, কলন্দর, আজাদি বা মিসকিন। কোনটা আরবি, কোনটা বা ফারসি।… দরবেশিয়ানায় ব্যাখ্যায় আছে, ‘ফকিরিয়ানা, গরিবিয়ানা, দরবেশিয়ানা গুজরান ইয়া মেজাজ।’ ফকির, গরিব, মিসকিন ইত্যাদি শব্দের মধ্যে দারিদ্র, নিঃসম্বলতা, নিঃস্ব অবস্থাও বোঝায়। সেটা যে আদৌ আধ্যাত্মিক তা কিছু নয়। গরিব গুর্বোর সাধারণ প্রতিশব্দ ফকির। কিছু না থাকা যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোই যেন এদের চিহ্ন, আস্তানা তো মানুষকে আটকে দেবে।

তলিয়ে ভাবলে মনে হতে পারে ফকিরিয়ানার দুটো চেহারা। একটা হল দীন দরিদ্র নিঃসম্বল নিঃস্ব মানুষ। আরেকটা হল একরকম ত্যাগব্রতী প্রবণতা, স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া দরিদ্র ঠাঁইনাড়া জীবন। এক্ষেত্রে বোঝা দরকার, জীবনকে গ্রহণ করবার দুটো ছক আছে— হয় দীনদারি না হয় দুনিয়াদারি। দুনিয়াদারি হল ভোগসুখ সহায় সম্পদ সম্পত্তি কর্তৃত্ব এবং তার পরিণামে অনিবার্য দুঃখ শোক বেদনা। আর দীনদারি মানেই বাহ্য উপভোগের সম্পদ আহরণের পথ ছেড়ে স্বেচ্ছায় দরিদ্র নিরুপাধি জীবনকে মেনে নেওয়া। 

অনেকে মনে করেন শরিয়তের পথ ছেড়ে যাঁরা মারফতির পথে এসেছেন তাঁরাই বুঝি ফকির। কিন্তু হিন্দু ফকিরও বহু আছেন। ফকিরিয়ানা একটা Life style বা জীবনপ্রবণতা বলাই ভাল। সুফিপন্থীরা ও সাধকরা পদব্রজে ঘুরে বেড়াতেন সর্বত্র। তাঁদের বাণী ও উপদেশ অনেক ব্যাপ্ত ছিল। ফকির, দরবেশরা তো স্বভাবেই ভ্রাম্যমাণ। তারা জমির টানে কোথাও স্থায়ী বাস্তু স্থাপনের নেশায় ছিলেন উদাসীন। ফকিরদের স্বর্গকামনা নেই, মানবদেহেই বেহেস্ত তাদের। 

ফকিরিয়ানার শেষ কথা হল গোপনীয়তা। জাহির নয় বাতুন। তাকে তালাশ করতে হবে অতলতার গোপনে। 

ফকির হওয়া সহজ কর্ম নয়ঃ

অনেকে বলেন, যিনি প্রকৃত ফকিরী নিবেন তার কোনও প্রকার জায়গা জমি, ধন দৌলতের প্রতি লোভ থাকা যাবে না। তাকে সকল কিছু বিসর্জন দিতে হবে। আমাদের রাসুল (সা.) ছেঁড়া মাদুরে ঘুমাতেন। কখনও নবী (সা.) দিনে দুবেলা খেয়েছেন আবার না খেয়েও থেকেছেন।

অদ্বিতীয় রবের প্রতি ফানাফিল্লাহ হয়ে (স্বীয় অস্তিত্ব বিলীন করলে) রবের ক্বাফশক্তিসমূহ অর্জিত হলে তাকে ফকির বলে। সহজ ভাষায়, ইহকাল ও পরকালের সকল কিছুর (নেয়ামতের) স্বাদ, কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্খা বাদ দিয়ে, এককথায় স্বীয় অস্তিত্বকে (নফসকে) বিলীন করে আল্লাহ্‌র মধ্যে বিলীন বা ফানা (ফানাফিল্লাহ) হয়ে যাওয়াকে ফকিরী বলে। যে ব্যক্তির ফকিরী হাসিল হয়েছে তাকে ফকির বলে। ফকির যখন ফানায় পূর্ণতা লাভ করে বা বাকা লাভ করে, তখন এক অদ্বিতীয় সত্তা আল্লাহ্‌ এবং ফকিরের মধ্যে কোনো অন্তরায় থাকে না।

যিনি নিজেকে যিকিরের মাধ্যমে ধ্যানের ঘরে আল্লাহর জাতের সাথে বিলিন করে দিয়েছে, নিজেকে আল্লাহর প্রেম রসে সর্বক্ষণ ডুবিয়ে রেখেছেন, তিনিই ফকির ৷ মহান আল্লাহ বলেন, আল ফাক্করু ফাক্করি আল ফাক্করু মীন্নি। অর্থ: ফকির আমার ভিতর আর আমি ফকিরের ভিতর।

সাধনার চারটি পথ— শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারফত। শরিয়ত মানে যা শরাসম্মত। ধার্মিক মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যেসব বিধান মেনে চলেন সেগুলি ‘কোরান’ ও ‘হাদিস’ থেকে পাওয়া। এ ধরনের বিধানগুলিকে একত্রে বলে ‘শরিয়ত’। ‘তরিকত’ মানে যা বিভিন্ন তরিকা বা মার্গসম্মত। ‘হকিকত’ অর্থে যা হক (ন্যায়) সম্মত। আর ‘মারফত’ বা মারিফত হল অধ্যাত্ম জ্ঞানের পথ। সুফিরা নেন তরিকতের মার্গ। এ পন্থায় জিকির সহযোগে মুরাকিবা বা সতত সাধনার সাহায্যে পরম প্ৰেয়র সঙ্গে অভেদ হওয়ার প্রয়াস পান সাধক। এই প্রয়াসে ‘ফানা’ বা অহং লুপ্ত হওয়াই চরম নয়, শেষ কথা হল ‘বাকা’ অর্থাৎ ফানায় চিরন্তন হয়ে যাওয়া।

সুফিরা ভাবসাধক ও আত্মস্থ। ইসলামের নানা কর্মকাণ্ড ও আকিদা-র বাড়াবাড়ির চেয়ে তাঁরা নিভৃত নির্জনে একক ধ্যানে ও অনুভবে একীভূত হতে চান এবং সেই একীভূত অবস্থাতেই থেকে যেতে চান বরাবরের জন্য। আসলে সুফিবাদ ইসলামের এক ভিন্ন দিশা, যা মুক্তমনা ও বিচারশীল মুসলমানদের ভাবাশ্রয় দিয়েছে বহুদিন ধরে। বলা বাহুল্য এদেশে ফকিরি মত গড়ে উঠেছে বহুলাংশে সুফিবাদের অনুপ্রেরণায়।

ভিন্নমতের সমালোচনাঃ

প্রচলিত ফকির সমাজ ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে মুসলিম বিশ্বের মূলধারার আলেমগণ অনেক সমালোচনা করেন। তাদের মতে, বর্তমান ফকিরদের কেউ কেউ ইসলামের ঐশী স্প্রিট থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে।

তাদের মতে, ফকির ও সুফি একই স্তরের নয়। সুফিবাদ মূলত ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শরিয়ত মেনে চলে আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের শিক্ষা দেয়। বিপরীতে প্রচলিত ফকিররা শরিয়ত থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন মনগড়া পন্থা অবলম্বন করে আত্মিক মুক্তির জন্য সাধনা করেন। 

তবে অনেকে বলেন, বৈষয়িক জ্ঞান দিয়ে ভেদজ্ঞানকে বুঝা কঠিন ব্যাপার। ভাসা ভাসা এক বস্তা ধর্মশাস্ত্রের পাণ্ডিত্য দিয়ে এই বিষয়টি বুঝবার কোন ব্যবস্থাপত্র নেই। যেসব আলেমের বাহ্যিক তথা পুস্তকের জ্ঞান ছাড়া ভেদজ্ঞানের অভাব ছিল, তাদের যুক্তি ইলমে গায়েব তথা মারেফত দর্শনের কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল।

তাঁদের একটা কথা হল আল্লার অনুভব হতে পারে ‘সিনা’-য় অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে, ‘সফিনা’-য় অর্থাৎ শাস্ত্রগ্রন্থ মাধ্যমে নয়। তাই অন্তরঙ্গ অনুশীলনই মারেফত। ‘সাধারণ প্রথাগত শাস্ত্রীয় পথে মানসিক শান্তি, আত্মগত জ্ঞানলাভ, আত্ম-উৎসর্গ ও আত্ম-সংযম সম্ভব নয়।’ তাই শরিয়তকে পেরিয়ে তবে মারেফতে পৌঁছতে হয়। মারেফত মানে প্রকৃত জ্ঞান, যার নির্দেশ জাহেরি কোরানে নেই, আছে অতি গোপনে। সেটা জানতে হয় মুর্শেদের কাছে দীক্ষা নিয়ে। সেই জ্ঞান শাস্ত্রপথে আসেনি, চলে আসছে বহুকাল থেকে সিনায় সিনায়। মারফতি ফকিরদের আলেমরা সহ্য করতে পারেন না, তার কারণ, মারফতিরা শরিয়তকে চরম বা পরম বলে মানেন না— আরও এগোতে চান আত্মদীপনের গহন পথে। সেই দীপন বা দর্শন তো মানুষকে দেখানো যায় না, উপলব্ধি করতে হয়। 

শরিয়তের মধ্যেই অন্তঃশীল হয়ে আছে মারেফত, যেমন দুধের মধ্যে মাখন। কিন্তু মাখন তুলে নিলে দুধ যেমন মূল্যহীন ঘোলে পরিণত হয় তেমনই মারফতি তত্ত্বে নিষ্ণাত হলে শরিয়ত হয়ে পড়ে নগণ্য।

পীর-সুফী’র পরিচয়ঃ

পীর’ ফার্সি শব্দ। প্রবীণ, জ্ঞানী, পরিপক্ক, অভিজ্ঞসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয় প্রদানে ‘পীর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর ব্যবহারিক অর্থে ইসলামের নিগূঢ় তত্ত্বে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিই পীর। আরবী ভাষায় ‘পীর’ শব্দের পরিবর্তে ‘সুফী’ ব্যবহৃত হয়। এই পীর-সুফীগণ, ভক্তদের আধ্যাতিক গুরু।

কারণ, দেহকে বলিষ্ট রাখার জন্য যেমনি খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি আত্মাকে সজীব রাখার জন্য আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজন হয়। পীর-সুফীগণ সেসব দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সুফীগন নিজের আমিত্বকে বিলীয়ে দিয়ে বিশ্ব পালকের সান্নিধ্য লাভের জন্য কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্থায়ীত্ব-অমরত্ব লাভ করেন।

বাংলাদেশে পীর, ফকির, দরবেশ, অলি-আউলিয়া ও সুফি-সাধকদের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা কঠিন। ২৬১ হিজরির ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে মহান অলি সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ইরানের বোস্তান নগরে ইন্তেকাল করেন।

চট্টগ্রামে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) কখন আগমন করেন তার সঠিক কোনো দিন-তারিখ জানা যায় না। তবে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে তিনি চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কঠোর সাধনা ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সেখানে তাঁর আস্তানা গড়ে তোলেন এবং পরে ইরানের বোস্তান নগরে আবার ফিরে যান। তাই আমরা ধারণা করতে পারি, বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ইন্তেকালের আগে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে এ দেশে আগমন করেন।

এরপর একে একে আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে পীর, ফকির, দরবেশ, অলি-আউলিয়া ও সুফি-সাধকদের এ দেশে আগমন ঘটতে থাকে। তবে ১১ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এ দেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়। 

দরবেশ (উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে)
দরবেশ (ফার্সিدرویش)হল এমন একজন ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তি যিনি বস্তুগত দারিদ্র্যকে বেছে নিয়েছেন বা গ্রহণ করেছেন। দরবেশ বা দারভেশ শব্দটি ফার্সি এবং তুর্কি ভাষায় পাওয়া যায়। এটি আরবি শব্দ ফকির -এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অহংকার ও নফসের বিভ্রম পরিত্যাগ করে আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর জন্যে তাদের মূল ফোকাস হয় ভালবাসা এবং সেবার সার্বজনীন মূল্যবোধের উপর।

বেশিরভাগ দরবেশ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্যে বিভিন্ন শারীরিক পরিশ্রম বা ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে যিকির অনুশীলন করার জন্য পরিচিত।তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুশীলন হল সামা, যা ১৩ শতকের বিশিষ্ট দরবেশ রুমির সাথে সম্পর্কিত। লোককাহিনীগুলোতে দরবেশদের প্রায়শই অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা এবং অলৌকিক ক্ষমতার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ঐতিহাসিকভাবে দরবেশ শব্দটি বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন বা সামরিক সত্তার উপাধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।

আমি কোনও ধর্মবিশেষজ্ঞ, ধর্মগুরু কিংবা সূফীসম্রাট নই। একজন অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক কেবল। ধর্মবিষয়ক পত্রিকা, ব্লগ ও উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য নিয়ে শব্দের বুননে লেখাটি সম্পাদনা করে পরিবেশন করেছি মাত্র।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top