কুমারী পূজাতে মাতৃরূপে ঈশ্বরের আরাধনা
সুজন হাসান | প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪২
দুর্গাপূজা এসেছে। এসেছেন ত্রিনয়নী মা শারদীয় এই দুর্গোৎসবে। মা দেবী দুর্গার আশীর্বাদে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করার পর সীতাকে উদ্ধার করলেন। সেই থেকে শরৎকালে হয়ে আসছে দুর্গাপূজা। শরৎকালে, অর্থাৎ দক্ষিণায়নে সব দেব-দেবীর মতো দেবী দুর্গা বিষ্ণুমায়া নিদ্রিতা থাকেন। শারদীয় দুর্গাপূজায় বোধন হচ্ছে, যার নামে নিদ্রিত দেবীকে জাগ্রত করা বোঝায়।
তাঁর জাগরণের জন্য এই শরৎকালকে অকালবোধনের দ্বারা দেবীকে জাগ্রত করা হয় বলে দুর্গার অপর নাম শারদীয়া। মা দুর্গা দেবী স্বামী মহাদেবের কাছ থেকে অন্ন খেতে চেয়েছেন বলে তাঁকে অন্নপূর্ণা পূজা বলে। দুর্গা হলো জীবের তথা দেবতাদের দুর্গতি যিনি নাশ করেন, আবার দুর্গম অসুরকে যিনি বধ করেন।
মানবসভ্যতার প্রাচীনতম সাহিত্য বা মানুষের প্রাচীনতম ‘লিপিবদ্ধ ইতিহাস’ ঋগ্বেদে আমরা আমাদের ধারণার সমর্থন পাচ্ছি। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্তটি ‘দেবীসূক্ত’ নামে প্রসিদ্ধ। মানবসভ্যতার পূর্বাহ্ণে উচ্চারিত এই সূক্তে আমরা ঋষি অম্ভৃণের কন্যা ঋষি বাকের উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত হই। ঋষি বাক উপলব্ধি করেছিলেন : জগৎ-প্রপঞ্চের পিছনে জগৎ-কারণরূপে যিনি অবস্থান করছেন, যার অঙ্গুলিহেলনে বা ইচ্ছানুসারে সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র প্রভৃতি পরিচালিত হচ্ছে, যার প্রভাব ভিন্ন রুদ্র তার ধনুকে জ্যা-রোপণে অসমর্থ, ব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুর মধ্যে যিনি ওতপ্রোতভাবে অনুস্যূত ও পরিব্যাপ্ত এবং তার বাইরেও যিনি বিদ্যমান, তিনি একজন নারী। তিনিই জগতের ঈশ্বরী-আদ্যাশক্তি। দেবীসূক্তের পর ‘রাত্রিসূক্ত’। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৭তম সূক্তটিই বিখ্যাত ‘রাত্রিসূক্ত’।
এই সূক্তে তৎকালীন মানুষের যে-পরিচয় আমরা পাচ্ছি সে-মানুষ হিংস্র প্রাণী ও দুর্ধর্ষ দস্যুদের পীড়নে আর্ত এবং সন্ত্রস্ত, শত্রুর (অসুরের?) আক্রমণের আশঙ্কায় সদাউদ্বিগ্ন। শঙ্কাহীন নিরুদ্বেগ জীবন ও শত্রুনাশের জন্য সে তাই ব্যাকুলভাবে প্রার্থনারত। স্মরণাতীত কালে আমাদের এই অগ্রজদের প্রার্থনা কার কাছে? কার উদ্দেশে তারা নতজানু? রাত্রিসূক্তের ঋষি কুশিকের ভাষায় তিনি হলেন সর্বব্যাপিনী, বিশ্ববিধাত্রী, বিশ্বত্রাত্রী, বিশ্বপ্রসবিত্রী, জগৎ-প্রকাশিকা আদ্যাশক্তি। ঋষি তাকে ‘রাত্রি’ নামে অভিহিত করেছেন। ভাষ্যকারের মতে, ‘রাত্রি’ শব্দের অর্থ—‘অভীষ্টদাত্রী’ (‘রাত্রি = দদাতি অভিষ্টম্ ইতি রাত্রিঃ৷’) শুধু ঋগ্বেদেই নয়, সামবেদেও ‘রাত্রিসূক্ত’ আছে। সেখানেও দেখি, আদ্যাশক্তির আদেশে সূর্য, বায়ু, বরুণ, পৃথিবী নিজ নিজ ভূমিকা পালন করছেন। অসুরবধের জন্য, অমঙ্গলনাশের জন্য তিনি বারবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। যজুর্বেদ ও অথর্ববেদের মধ্যেও বিভিন্ন স্ত্রী-দেবতার উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন বেদের আরণ্যক, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ অংশ বহু স্ত্রী-দেবতার নাম বহন করছে। পণ্ডিতদের মতে, দেবীসূক্তের বাক এবং রাত্রিসূক্তের রাত্রি পরবর্তীকালে যথাক্রমে সরস্বতী ও কালীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। ঋগ্বেদের পরিশিষ্টের অন্তর্গত ‘শ্রীসূক্ত’-এর মধ্যে ঋগ্বেদের শেষের দিকের শক্তিভাবনার উল্লেখ পাই। পণ্ডিতদের মতে ‘শ্রীসূক্ত’-এর শ্রী পরবর্তীকালে লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
শক্তিপূজা কেবল মাতৃমূর্তিতেই হয়। যেমন: দুর্গা, অন্নপূর্ণা, কালী, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি। তাই প্রাচীনকাল থেকে শক্তিপূজার অঙ্গ হিসেবে নারীমূর্তিতে কুমারীপূজা প্রবর্তিত হয়েছে। বর্তমানকালের সমাজব্যবস্থায় বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নয়নশীল বিশ্বে সমাজব্যবস্থায় নারী নির্যাতিতা। তাই নারীদেহে ভগবানের পূজা সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজ স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পুজো করে মাতৃ সম্মানের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কুমারীপূজার মাধ্যমে নারী সমাজের তথা মাতৃশক্তি জাগরণের এক অত্যুজ্জ্বল ধারা বর্তমান সমাজে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জানিয়েছে, দেশের ৩১ হাজার ৪৬১টি মন্দির ও মণ্ডপে এবার পূজা হবে। গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৪০৮টি। তবে ঢাকা মহানগরে এবার ২৫২টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, গত বছর হয়েছিল ২৪৮টিতে। সে হিসেবে মহানগরে পূজামণ্ডপ চারটি বেড়েছে। এ সব মণ্ডপে শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজা উদযাপন কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রতিটি মণ্ডপে স্থাপন করা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হয়েছে মণ্ডপ পাহারার জন্য।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।