আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৫২

ছবি: সংগৃহীত

সারা বিশ্বের চোখ আজ যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে আজ নির্ধারণ হচ্ছে, আসছে চার বছরের জন্য কে হতে যাচ্ছেন বিশ্বের সবথেকে ক্ষমতাধর মানুষ। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলেছে। যদিও জরিপগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস খানিকটা এগিয়ে আছেন। সারা বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ৫ থেকে ৬টি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের দিকে; যেখান থেকে কমলা-ট্রাম্পের ভাগ্য নির্ধারণ হবে।

এদিকে আজকের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেষ মুহূর্তে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো চষে বেড়িয়েছেন দুই প্রার্থী। সেখানে কমলা গাজা যুদ্ধ অবসানের আশা দেখালেও ট্রাম্প তার পুরোনো অন্ধকার ছড়িয়েছেন। ২০২০ সালে হোয়াইট হাউস ছেড়ে ভুল করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন এই রিপাবলিকান প্রার্থী। বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, এবারের মার্কিন নির্বাচন ফ্যাসিস্ট ট্রাম্প আর স্বৈরতন্ত্রী কমলার মধ্যকার লড়াই।

কী বলছে জরিপগুলো : গতকাল সোমবার প্রকাশিত টিআইপিপি জরিপ অনুযায়ী দুজনের ভোট ৪৮ শতাংশ। শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত ১ হাজার ৪১১ জন নিবন্ধিত ভোটারের ওপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। এই ভোটারদের ৬ শতাংশ টিআইপিপিকে বলেছে, তারা তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন। এই জরিপে মার্জিন অব এরর দেখানো হয়েছে ২.৭ শতাংশ।

এবিসি নিউজের জরিপে কমলা (৪৯ শতাংশ) ট্রাম্পের (৪৬ শতাংশ) চেয়ে ৩ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। গত মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে অংশ নিয়েছেন ২ হাজার ২৬৭ জন নিবন্ধিত ভোটার। এখানে মার্জিন অব এরর দেখানো হয়েছে ২ শতাংশ। গত রোববার প্রকাশিত এনবিসি নিউজের জরিপ অনুযায়ী, দুই প্রার্থীর সমর্থনই ৪৯ শতাংশ। বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ১ হাজার ভোটারের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। একইভাবে এমারসন কলেজের জরিপেও দেখা গেছে দুই প্রার্থীর সমর্থনই ৪৯ শতাংশ।

এদিকে মর্নিং কনসাল্টের শেষ জরিপ অনুযায়ী ট্রাম্পের থেকে ২ শতাংশ ভোটে এগিয়ে আছেন কমলা। ৮ হাজার ৯১৮ জনের ওপর পরিচালিত ওই জরিপ অনুযায়ী হ্যারিসের সমর্থন ৪৯ শতাংশ। আর ৪৭ শতাংশ সমর্থন রয়েছে ট্রাম্পের। এখানে মার্জিন অব এরর দেখানো হয়েছে ১ শতাংশ। এদিকে আগাম ভোটের বুথফেরত জরিপে কমলা হ্যারিসকে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে জরিপের ফল সবসময় যথাযথ হয় না। ২০১৬ ও ২০২০ সালের নির্বাচনের জরিপ ভুল প্রমাণ হয়েছিল।

২৭০ ইলেকটোরাল ভোটের অঙ্ক: যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে প্রার্থীকে সাধারণত দুই ধরনের ভোটে জিততে হয়। এর একটি নাগরিকদের সরাসরি ভোট, যা ‘পপুলার ভোট’ হিসেবে পরিচিত; আরেকটি হচ্ছে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এই দুটির মধ্যে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটেই প্রার্থীর চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। এ ব্যবস্থায় প্রার্থীদের জয়-পরাজয় জাতীয়ভাবে না হয়ে নির্ধারিত হয় একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনি লড়াইয়ের মাধ্যমে। দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো অঙ্গরাজ্যে পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে একদল কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করে থাকেন, তাদের বলা হয় ইলেকটর। এই ইলেকটররাই নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। একটি রাজ্যের ইলেকটরদের একসঙ্গে ইলেকটোরাল কলেজ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) দেশটিতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫১টি। এই ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে।

একেকটি রাজ্যে ইলেকটরের সংখ্যা একেকরকম। এটি নির্ধারিত হয় মার্কিন কংগ্রেস রাজ্যের কতজন প্রতিনিধি ও সিনেটর আছেন সে হিসেবে। সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দুই কক্ষে থাকা আসনের (প্রতিনিধি পরিষদে ৪৩৫, সেনেটে ১০০) বিপরীতে রাজ্যগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত ইলেকটর পায়। কংগ্রেসে রাজধানী অঞ্চল ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও সেখান থেকে আসেন তিনজন ইলেকটর।

নির্বাচনের দিন ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিলেও আসলে তারা ৫১টি ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত করে তাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে এই ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হয়। অর্ধশত রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই হাতে আসে হোয়াইট হাউসের চাবি। বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রেই ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের বাধাধরা ভোটব্যাংক রয়েছে। সে কারণেই বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রেই আগে থেকে জানা যায়, কারা জয়ী হচ্ছেন।

জিততে হ্যারিসকে যা করতে হবে: সিএনএনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ইতিমধ্যে ১৯ অঙ্গরাজ্যের ২২৬ ইলেকটোরাল ভোট নিশ্চিত করেছেন হ্যারিস। এখন তারা পেনসিলভানিয়া (১৯ ইলেকটোরাল ভোট), উইসকনসন (১০ ইলেকটোরাল ভোট) আর মিশিগানে (১৫ ইলেকটোরাল ভোট) জয় পেলে তাদের ২৭০ ইলেকটোরাল ভোটের বৈতরণী পার হতে সক্ষম হবে।

তবে পেনসিলভানিয়ায় যদি ট্রাম্প ২০১৬ সালের মতো করে জয় পায়, সে ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের জয় কঠিন হবে। তাদের নজর দিতে হবে দক্ষিণে, যার অন্যতম নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্য (১৬ ইলেকটোরাল ভোট)। ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫টি নির্বাচনের মধ্যে কেবল ২০০৮ সালে বারাক ওবামার সময় সবশেষ ডেমোক্র্যাটরা জয় পেয়েছে। পেনসিলভানিয়ায় হারলে তাদের ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট নিশ্চিতে এই অঙ্গরাজ্যে জয় পেতেই হবে। পাশাপাশি নেভাদায় (৬ ইলেকটোরাল ভোট) জয় পেলে তাদের লক্ষ্য নিশ্চিত হতে পারে।

ট্রাম্প যেভাবে জয় পেতে পারেন: সিএনএনের বিশ্লেষণ অনুযাযী, কমলার ২২৬ ভোটের বিপরীতে ট্রাম্পের হাতে থাকা নিশ্চিত ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ২১৯টি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য বিজয়ের সবচেয়ে সহজ পথ হলো নর্থ ক্যারোলিনায় তার জয় ধরে রাখা। আবার তিনি জর্জিয়াকে ছিনিয়ে নিতে পারলে এবং পাশাপাশি পেনসিলভানিয়ায় জিততে পারলে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন।

এদিকে হ্যারিস যদি পেনসিলভানিয়ায় জিতে যান, সে ক্ষেত্রে ২৭০ তে পৌঁছানোর জন্য ট্রাম্পকে তিনটি অতিরিক্ত রাজ্য জিততে হবে। নেভাদা এবং অ্যারিজোনাই যথেষ্ট হবে না, তাকে মিশিগানের মতো ব্লু ওয়াল রাজ্যের একটিতে জয়ী হতে হবে।

দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে শেষ মুহূর্তের প্রচার: হ্যারিস রোববার তার প্রচারের শেষ দিন কাটান পেনসিলভানিয়ায়। সেখানে অ্যালেনটাউন, পিটসবার্গ এবং ফিলাডেলফিয়ায় তিনি সমাবেশ করেন। অন্যদিকে ট্রাম্প শেষ নির্বাচনি প্রচারে কাটান তিন দোদুল্যমান রাজ্য নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া এবং মিশিগানে।

শেষ দিনের এই প্রচারে ট্রাম্প অতীতের বুলি আওড়ে বলেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে হারের পর তার হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়া উচিত ছিল না। পেনসিলভানিয়ায় এ বছরের ভোটে জালিয়াতি হওয়ার অভিযোগেরও পুনরাবৃত্তি করছেন তিনি। অতীতের মতোই তার এই দাবির স্বপক্ষে ট্রাম্প কোনো প্রমাণও দেননি।

ওদিকে হ্যারিস মিশিগানের গুরুত্বপূর্ণ আরব-আমেরিকান ভোট দলে টানার চেষ্টায় আছেন। নির্বাচিত হলে গাজায় যুদ্ধ অবসান করতে তার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে ভোটারদের কাছে তুলে ধরেছেন হ্যারিস। অক্টোবরের রয়টার্স/ইপসোস জরিপেও দেখা গেছে, ভোটাররা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতির পর আজ দ্বিতীয় যে সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তা হচ্ছে গণতন্ত্রে হুমকি।

তবে ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, দেশের অর্থনীতি এবং উচ্চমূল্য, বিশেষ করে খাবার এবং আবাসনে উচ্চমূল্য নিয়ে ভোটারদের উদ্বেগই তাকে হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দেবে। রোববারের প্রচারে পেনসিলভানিয়ার এক সমাবেশে তাই অর্থনীতি নিয়েই ভোটারদের বার্তা দিয়েছেন ট্রাম্প। বলেছেন, ‘আমরা আপনাদের কর কমাব, মূল্যস্ফীতির অবসান ঘটাব, উচ্চমূল্য সমস্যার সমাধান করব, বেতন বাড়াব এবং আমেরিকায় আবার হাজার হাজার কারখানা ফিরিয়ে আনব।’

কী বলছেন বিশ্লেষক: যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া নাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাবাদী। তিনি কীভাবে ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তা প্রকাশ করেননি। তবে নিউ স্টেটম্যানসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ট্রাম্প সবচেয়ে বড় হুমকি। তিনি এই নির্বাচনকে ‘ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদ এবং হ্যারিসের স্বৈরাচারীর মধ্যে একটি দ্বিদলীয় প্রতিযোগিতা’ আখ্যা দিয়েছেন। সূত্র: সময়ের আলো



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top