নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:২৪
মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ আল দেইফের বিরুদ্ধেও একই পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত আইসিসি গতকাল এ পরোয়ানার বিস্তারিত তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো এখন আইনত বাধ্য নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করতে। এমন ১২৪টি দেশের মাটিতে পা দেওয়া তাই এখন নেতানিয়াহুর পক্ষে কার্যত অসম্ভব। ওসব দেশে গেলেই সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার তাকে গ্রেফতারে বাধ্য।
পরোয়ানা জারি হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেতানিয়াহু ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই পরোয়ানাকে ইহুদিবিদ্বেষী অ্যাখ্যা দিয়েছেন। হাঙ্গেরি ও আর্জেন্টিনা নেতানিয়াহুর পক্ষে অবস্থান নিলেও বেশিরভাগ দেশ তার বিরুদ্ধে জারি হওয়া পরোয়ানার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, নেতানিয়াহু তার দেশে গেলেই গ্রেফতার হবেন। আর ইরান বলেছে, এই পরোয়ানার মধ্য দিয়ে ইসরাইলের মৃত্যু ঘটবে।
ছোট হয়ে এলো নেতানিয়াহুর আকাশ : দ্য হেগে অবস্থিত আইসিসি বৃহস্পতিবার অনলাইনে এক সিদ্ধান্তে জানান, ইসরাইলে গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা এবং এর জের ধরে গাজায় দেশটির গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর ঘটনায় নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট ও হামাসের নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই তিনজন এখন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি বলে গণ্য হবেন এবং তাদের গ্রেফতার করতে আইসিসিভুক্ত দেশগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে।
ওই পরোয়ানা জারির অর্থ হলো- গ্রেফতার হলে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে যতক্ষণ গ্রেফতার না হচ্ছেন, ততক্ষণ তাদের বিচার শুর” হচ্ছে না। কেননা, অনুপস্থিতিতে তাদের বিচার করার এখতিয়ার এ আদালতের নেই। গ্রেফতার পরোয়ানা জারির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক ও ব্রিটিশ সোসাইটি ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক নেভ গর্ডন আলজাজিরাকে বলেন, আইসিসির কাছে এটি একটি জোরালো মামলা এবং ক্ষুধাকে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে ইসরাইলি নেতাদের অস্ত্র বানানোর বিষয়টি প্রমাণ করা মোটামুটি সহজই হবে।
আলজাজিরা বলছে, আদালতের এ পরোয়ানার ফলাফল বাস্তবে দেখা যেতে পারে। আগে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট যেভাবে বিদেশে ভ্রমণ করেছেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন সফর করাটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে। কেননা, বিদেশ সফরে গিয়ে গ্রেফতার হতে পারেন তারা।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের গ্রেফতার হওয়ার এমন সম্ভাবনা থাকার কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সনদে ১২৪টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এসব দেশে সফরে গেলে তাদের গ্রেফতার করতে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে। অবশ্য এ গ্রেফতার পরোয়ানা ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর হবে না। দুটি দেশই এ আদালতের সদস্য না হওয়ায় পরোয়ানা মানতে বাধ্য নয়। বাস্তবেও নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর করলে তাদের ওই আদালতের কাছে সম্ভবত তুলে দেবে না দেশটি।
পরোয়ানায় ক্ষুব্ধ নেতানিয়াহু ও সঙ্গীরা : বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, ‘দ্য হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইহুদিবিদ্বেষী যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, তা আধুনিক যুগের ড্রেফাস ট্রায়াল। আর এর সমাপ্তিটাও একই হবে।’ ড্রেফাস ট্রায়াল বলতে তিনি এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে ফ্রান্সের আলোচিত একটি ঘটনাকে ইঙ্গিত করেছেন। তখন ফ্রান্সে সেনাবাহিনীর ইহুদি ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ড্রেফাসকে অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। পরে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।
নেতানিয়াহু বলেছেন, আইসিসির সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে স্বীকার করবে না ইসরাইল। ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বিবিসিকে বলেন, নেতানিয়াহু হামাসের সঙ্গে সংঘাতকে যেভাবে সামলাচ্ছেন, তা নিয়ে সমালোচনা করলেও তিনি আইসিসির সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন। রেডিও ফোরের ওয়ার্ল্ড টুনাইট অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওলমার্ট বলেন, ‘ইসরাইল জাতিগত নিধন বা যুদ্ধাপরাধ করেনি যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা যাবে।’
পক্ষে-বিপক্ষে অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া : ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও ইতালির কর্মকর্তারা আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার বলেছে, তারা আদালতের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আইসিসি যাই বোঝাক না কেন, ইসরাইল এবং হামাস কোনোভাবেই সমতুল্য নয়। নিরাপত্তাকে হুমকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই ইসরাইলের পাশে থাকব।’
এএফপির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আর্জেন্টিনাও আদালতের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে দেশটির প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে হামাস এবং হিজবুল্লাহর মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের ক্রমাগত হামলার বির”দ্ধে ইসরাইলের আত্মরক্ষার বৈধ অধিকারকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হাঙ্গেরি সফরে আমন্ত্রণ জানাবেন। শুক্রবার (২২ নভেম্বর) তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তা হাঙ্গেরিতে মানা হবে না।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তুরস্ক, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন ও বেলজিয়াম এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলেছে।
আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেছেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পরোয়ানা জারি করায় নেতানিয়াহু আয়ারল্যান্ডে এলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রীও জানিয়েছেন, তারা আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবেন।
ইসরাইলের মৃত্যু দেখছে ইরান : নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ইসরাইলের ‘‘শেষ এবং রাজনৈতিক মৃত্যু’ হিসাবে অভিহিত করেছে ইরান। শুক্রবার ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসির প্রধান জেনারেল হোসেইন সালামি এক বক্তৃতায় এই মন্তব্য করেছেন।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত বক্তৃতায় বিপ্লবী গার্ডের এই প্রধান বলেছেন, ‘আইসিসির পরোয়ানার অর্থ ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের অবসান এবং রাজনৈতিক মৃত্যু। ইসরাইল এমন এক রাষ্ট্র যা আজ বিশ্বে পুরোপুরি রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে রয়েছে এবং তাদের কর্মকর্তারা অন্য কোনো দেশে আর ভ্রমণ করতে পারেন না।’
যে দেশগুলো নিষিদ্ধ নেতানিয়াহুর জন্য : আইসিসির এই সিদ্ধান্তের পর নেতানিয়াহু ও গালান্তকে যেসব দেশে আটক করা হতে পারে তার তালিকা এখানে দেওয়া হলো- আফগানিস্তান, আলবানিয়া, অ্যান্ডোরা, অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডা, আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বাংলাদেশ, বার্বাডোস, বেলজিয়াম, বেলিজ, বেনিন, বলিভিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, বতসোয়ানা, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, বুর্কিনা ফাসো, কেপ ভার্দে, কম্বোডিয়া, কানাডা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান, চাদ, চিলি,
কলম্বিয়া, কোমোরোস, কঙ্গো, কুক দ্বীপপুঞ্জ, কোস্টা রিকা, আইভরি কোস্ট, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক রিপাবলিক, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ডেনমার্ক, জিবুতি, ডমিনিকা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েডর, এল সালভাদর, এস্তোনিয়া, ফিজি, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্যাবন, গাম্বিয়া, জর্জিয়া, জার্মানি, ঘানা, গ্রিস, গ্রানাদা, গুয়াতেমালা, গিনি, গায়ানা, হন্ডুরাস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, জর্ডান, কেনিয়া, কিরিবাতি, লাটভিয়া, লেসোথো, লাইবেরিয়া,
লিচেনস্টাইন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাদাগাস্কার, মালাউই, মালদ্বীপ, মালি, মাল্টা, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মরিশাস, মেক্সিকো, মঙ্গোলিয়া, মন্টিনিগ্রো, নামিবিয়া, নাউরু, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নাইজার, নাইজেরিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া, নরওয়ে, ফিলিস্তিন, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, পোল্যান্ড, পর্তুগাল,
কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, মলদোভা প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডাইনস, সামোয়া, সান মারিনো, সেনেগাল, সার্বিয়া, সেশেলস, সিয়েরা লিওন, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুরিনাম, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, তিমুর-লেস্তে, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, তিউনিসিয়া, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য, তানজানিয়া ইউনাইটেড রিপাবলিক, উরুগুয়ে, ভানুয়াতু, ভেনেজুয়েলা ও জাম্বিয়া। সূত্র: সময়ের আলো, বণিক বার্তা
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।