মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেন আরও ১১৪ জন

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১৩:৪৮

ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের রাখাইনে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষ ঘিরে তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যরা।

দেশটি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ১১৪ জন। এঁদের মধ্যে মিয়ানমারের সেনাসদস্য, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছে। এ নিয়ে গত রোববার থেকে দেশটির মোট ২২৯ জন পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, যাঁদের বেশির ভাগ বিজিপি সদস্য।

আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতবিল সীমান্ত দিয়ে নতুন করে মিয়ানমার থেকে বিজিপি, সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের পালিয়ে আসার ঘটনা ঘটে। তাঁদের রহমতবিল বিজিবি ফাঁড়িতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সূত্র জানিয়েছে, যে ১১৪ জন আজ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যই নয়, দেশটির সেনাসদস্য, শুল্ক কর্মকর্তা ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন। বিজিবি হেফাজতে তাদের সবার পরিচয় নেওয়ার কার্যক্রম এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চলছিল।  

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, বিজিপি সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। চলমান এই সংঘর্ষ ঘিরে শিশুদের নিয়ে অনেক পরিবার পায়ে হেঁটেই রাখাইন ছাড়ছে। 

শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে সীমান্ত শিবির দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী দলগুলোর সংঘর্ষ চলছে। ক্রমাগত গুলি, মর্টার শেল ও রকেট বিস্ফোরিত হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় এক বাংলাদেশিসহ দুজন নিহত হয়েছেন।

বাংলাদেশের সীমান্তে দুজন নিহত হওয়ার পর স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার পর থেকে সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা বেড়ে চলছে। স্থানীয় ঘুমধুম ইউনিয়নের মানুষরা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেছেন।

স্থানীয় ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, 'গত তিন দিন আমার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তেমন ঝামেলা হয়নি। তবে আজ সন্ধ্যার পর থেকে অবস্থা বেশি খারাপ। মানুষজন যে যার মতো নিরাপদে চলে গেছে।'

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঢেঁকিবনিয়ার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার লোকালয়ের একদম কাছাকাছি।

ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয় প্রায় ৮০০ মিটার দূরে। ঢেঁকিবনিয়া ও ঘুমধুমের মাঝখানে নাফ নদীর সরু একটি শাখা ও প্যারাবন রয়েছে। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে। সংঘর্ষের জেরে সীমান্ত-লাগায়ো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের গণমাধ্যম দ্য ইরাবতীর প্রতিবেদন অনুসারে, গত চার দিনে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ ঘাঁটি আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। এ পর্যন্ত সংঘাতে জান্তা বাহিনীর অন্তত ৬২ জন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং সশস্ত্র সংগঠনগুলো মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজ্য, সাগাইং, মগওয়ে এবং মান্দালয় অঞ্চলের পাশাপাশি কাচিন ও কারেন রাজ্যে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে তাদের হামলা জোরদার করার কারণে এই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

এদিকে, ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের বান্দরবানের তমব্রু-কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়া সীমান্তে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি নানা রকম উসকানি দিয়ে আসছিলেন বিজিপি সদস্যরা। বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গারা যাতে আর মিয়ানমারে ঢুকতে না পারে সে জন্য সীমান্ত ঘেঁষে একাধিক ট্রেঞ্চও তৈরি করেছিলেন।

এই বিজিপি সদস্যরা ২০১৪ সালের ২৭ মে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি লেম্বুরছড়ি সীমান্ত থেকে টহলে থাকা বিজিবির নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমান গুলি করে হত্যা করে। হত্যার পরও বিজিপি সদস্যরা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। পরবর্তীকালে বিজিবির হুঁশিয়ারির প্রেক্ষিতে ৫ দিন পর নায়েক সুবেদার মিজানের মরদেহ ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

একইভাবে ২০১৫ সালে মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যদের হাতে হিংস্রতার শিকার হয়েছিলেন বিজিবির নায়েক রাজ্জাক। ওই বছরের ১৭ জুন ভোরে নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে টহল দেয়ার সময় বিজিপি সদস্যরা নির্বিচারে গুলি করে।

এসময় বিপ্লব নামে এক বিজিবি সদস্য গুলিবিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি অপহরণ করে নিয়ে যায় নায়েক রাজ্জাককে। দুই দেশের পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ৯ দিন পর রাজ্জাককে ২৫ জুন সন্ধ্যায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। আসামির মতো বন্দি করে ছবি তোলার পাশাপাশি এক বিজিপি সদস্য কামড়ে তার নাক ছিঁড়ে নিয়েছিলেন।

শুধু মিয়ানমার সীমান্ত নয়, ভারতীয় সীমান্তেও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী চরম ধৈর্য এবং মানবিকতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা প্রায়ই বাংলাদেশ সীমান্তে চলে আসলেও তাদের নিয়ম অনুযায়ী ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেয় বিজিবি। কিন্তু বিপরীতে বিএসএফ সদস্যরা নানা অজুহাতে সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীর পাশাপাশি বিজিবি সদস্যদেরও হত্যা করেছে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top