নির্মাণ হয়নি স্মৃতিফলক
স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও স্বীকৃতি মেলেনি গোপালগঞ্জের তারাকান্দর গণহত্যার
গোপালগঞ্জ থেকে | প্রকাশিত: ২ জুন ২০২১, ২২:৪২
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-আলবদরদের সহযোগীতায় পাকিস্থানী বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিলো ২৫ মার্চের কাল রাত থেকে। সেই থেকেই বাংলাদেশের একেকটি জনপদকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে পাকিস্থানী বাহিনী ও তাদের দোসররা। আর তেমনি একটি গণহত্যা হয়েছিল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের তারকান্দর গ্রামে।
বাংলা মাসের ১৯ জৈষ্ঠ্য (২ জুন) এদিন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার তারাকান্দর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মিলে তারাকান্দর গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে গণ-কবর দিয়েছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও স্বীকৃতি না মেলায় তারাকান্দর গণহত্যা রয়েছে লোক চক্ষুর অড়ালে। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরও এই গণহত্যার ইতিহাস অজানা থেকে গেছে সবার কাছে। ঠাঁয় হয়নি ইতিহাসের পাতায় তারাকান্দরে গণহত্যার।
এমনকি, স্বাধীনতার ৫০ বছরের এখানে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিফলক। দিবসটি উদযাপনে নেয়া হয় না কোন উদ্যোগ। শুধু স্বজনহারা মানুষেরা চোখের পানি ফেলে নিহতদের স্মরণ করেন। শহীদদের নামের তালিকা দিয়ে ওই স্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মানের দাবী জানিয়েছে নিহত ও আহতদের স্বজনেরা।
তারাকান্দর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে জানাগছে, ১৯৭১ সালের ১৯ জৈষ্ঠের (০২ জুন) সকালটা ছিল অন্যান্য দিনের মতো শুভ্র। কিন্তু, দিনের বাকীটা সময় যে রক্তের হলিখেলায় শুভ্র সকালটা রক্তবরণ ধারন করবে তা বুঝতে পারেনি সেই গ্রামের মানুষ।
এদিন কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গান বোটে করে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১জন পাকিস্তানী সেনা গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকার। এরপরই স্থানীয় দোসর রাজাকারদের সহযোগীতায় হিন্দু প্রধান এলাকা তারাকান্দর গ্রামে এসে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ।
এসময় মুক্তিকামী মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আশ্রয় নেয় ডোবায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুরের কচুরিপানার মধ্যে। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সাথে নিয়ে তারাকান্দর গ্রামের ঢুকে বিভিন্ন বাড়ী ঘরে লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করে ফেলে রেখে চলে যায়।
সকাল থেকে শুরু হয়ে এ হত্যাযজ্ঞ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ হত্যাকান্ডে পরিচয় পাওয়া রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তার দুই মেয়ে, পচু মণ্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মণ্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রীসহ শিশু-নারী এবং নাম না জানা বহু মানুষকে তারাকান্দর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। মাঠে ও পুকুর পাড়ে পরে থাকে সারি সারি লাশ।
এদিকে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও স্বীকৃতি মেলেনি তারকান্দর গণহত্যার। এমনকি দিবসটি পালন করা তো দূরের কথা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে নির্মান হয়নি কোন স্মৃতিফলক।
পাকিস্থানী হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার সাক্ষী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া নটবর রায় (৭৫) বলেন, পাকিস্থানী সেনা ও রাজাকারদের তাড়া খেয়ে ওইদিন একটি কচুরিপানা ভর্তি ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের পাশের একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। পাকিস্থানী সেনারা এই গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছিলো। নিজেকে কোন রকমে বাঁচাতে পেরেছিলাম। পাকিস্থানী সেনাবাহিনী চলে যাবার পর উপরে উঠে আসি তখন দেখি সারি সারি লাশের স্তুপ। সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে আঁতকে উঠি।
তারাকান্দর গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধা সবিতা রানী রায় বলেন, পাকিস্থানী বাহিনী যখন এ গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালায় তখন আমার বিয়ে হয়নি। প্রাণ বাঁচাতে বাবার সাথে খাল ঝাঁপিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরে আমার বিয়ে হলে এখানে ফিরে আছি। তখন পুকুর, খাল ও ডোবার মধ্যে সারি সারি মাথার খুলি, হাড়-গোড পড়েছিলো।
একই গ্রামের রমেশ রায় বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও তারাকান্দর গণহত্যার কোন স্বীকৃতি মেলেনি। এমন কি এখানে কোন স্মৃতিফলকও নির্মাণ হয়নি। এ কারনে আমার শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারি না। এমনকি নতুন প্রজন্মও এ গণহত্যার সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে না। আমরা চাই এ গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে এখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম মাহফুজুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ধরতে রাখতে আমাদের বদ্ধভূমিগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে এসব বদ্ধভূমি বা স্মৃতি সংরক্ষণ অত্যাবশ্যকীয়। ইতিমধ্যে তারাকান্দর বদ্ধভূমিটি সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুত বদ্ধভূমিটি সংরক্ষণ করা হবে।
এনএফ৭১/জেএস/২০২১
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।