ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ ৮০, তদন্ত শুরু হয়নি কোনোটারই
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৫৮
জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারের জন্য পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ১৮ ও ২০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে সাবেক মন্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৪৬ জনকে হাজির করার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল এ তারিখ নির্ধারণ করেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালে ৮০টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে, তবে কোনোটারই তদন্ত শুরু হয়নি।
অর্ন্তর্বতী সরকারের ১০০ দিনে বিচার নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কাজ হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন। তবে প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, গত তিন মাসে অনেক কাজ অগ্রসর হয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে; সংগ্রহ করা হয়েছে তথ্য-উপাত্ত। সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে ২ মাসের মধ্যে হয়তো দু’একটি মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত হবে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে শতবর্ষী ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নানামুখী সংস্কার কাজ শেষ পর্যায়ে। ট্রাইব্যুনাল ভবন চলতি মাসেই নান্দনিক রূপে দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, গত তিন মাসে ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন বিভাগ ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। তবে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হলেও তা তদন্তের পর্যায়ে আসেনি। সংশ্লিষ্ট অন্যরা জানিয়েছেন, অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পেলে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হবে।
গত ১৭ অক্টোবর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত সংস্থার করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। এর পর গত রোববার শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে রেড অ্যালার্ট নোটিশ
চেয়ে ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছে প্রসিকিউশন বিভাগ। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে, সব অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। জুলাই-আগস্টকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যেসব হত্যা মামলা হয়েছে, সেগুলো একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হবে।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেই প্রজ্ঞাপন এখনও মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়নি।
সাড়ে ১২ শর বেশি মামলা
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন মাসে হত্যা, গুম ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে রাজধানীসহ সারাদেশে সাড়ে ১২ শর বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি লক্ষাধিক। গ্রেপ্তার হয়েছে ৩২ হাজারের বেশি মানুষ। তাদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা মামলা। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে তিন শতাধিক। একের পর এক মামলা হয়েছে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা-পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনজীবী, অভিনেতা, দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। থানা বা আদালতে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর তদন্ত এখন পর্যন্ত শুরুই হয়নি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইন ১৯৭৩ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
ঢালাও মামলা, ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কা
বিভিন্ন ঘটনায় এ পর্যন্ত হওয়া মামলাগুলোর ধরন ও সংখ্যা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিহত অধিকাংশেরই ময়নাতদন্ত হয়নি। অধিকাংশ মামলাতেই দেখা গেছে, বাদী সব আসামি বা সাক্ষীকে চেনেন না। মামলায় অপরাধ প্রমাণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন দিকগুলোর ক্ষেত্রে দুর্বলতা ভাবিয়ে তুলেছে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের।
মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৬ আগস্ট থেকে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে হত্যাসহ নানা ধরনের সহিংসতার অভিযোগে হওয়া মামলায় লক্ষাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭০ জন শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর বাইরে সারাদেশে অন্তত ২০০ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন ১৩ জন। সব মিলিয়ে গ্রেপ্তারের সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, এসব মামলা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগীদের বানোয়াট মামলায় গ্রেপ্তার করলে কোনো ফল হবে না, যেমনটি আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। যে কোনো হয়রানির ফল ভালো হয় না– এটা সরকারের বোঝা উচিত।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক মনে করেন, এসব মামলার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এভাবে পাইকারি হারে কোনো ফৌজদারি মামলা হয় না। একটা মামলায় ৩-৪শ আসামি হলে গুরুত্ব অনেকাংশে কমে যায়। ভুলভাবে মামলা করা হচ্ছে– মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগে যেভাবে মামলা হতো, সেভাবেই হচ্ছে। এখন বিএনপি নেতাদের জায়গায় শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল সমকালকে বলেন, এজাহার একটি প্রাথমিক তথ্য। এখানে অনেক ভুল থাকতেই পারে। অপরাধ নির্দিষ্ট হবে মামলার তদন্তে। এজাহারে কোনো ভুল থাকলে এর বেনিফিট কখনোই আসামি পেতে পারে না। বিচার হবে তদন্ত রিপোর্ট এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। প্রাথমিক এজাহারের লেখা মুখ্য নয়।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আমিনুল গনি টিটো বলেন, ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে অধিকাংশ মামলা হয়েছে থানা বা আদালতে। এসব মামলায় হুকুমের আসামিও রয়েছেন। ফৌজদারি আইনে মামলার অপরাধ তদন্তে এবং বিচারে কিছু আলামতের গুরুত্ব অনেক বেশি। এসব অভিযোগ প্রমাণ করা খুবই কঠিন হবে।
গত ১২ নভেম্বর অর্ন্তর্বতী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গায়েবি মামলা হতো। আর এখন ভুক্তভোগী সাধারণ লোকজন ঢালাওভাবে মামলা করছে। ঢালাও মামলা অত্যন্ত বিব্রতকর।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক বেশি আসামি করে দায়ের করা মামলার ফল খুব ভালো হবে না। কারণ, এত সংখ্যক আসামির বিরুদ্ধে তদন্তের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। এতে ভুক্তভোগীর পরিবার ন্যায়বিচার পাবে কিনা– সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। খবর সমকালের।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।