রেডিও জকি বা আর-জে হয়ে ওঠার ঝোঁক কি চলে গেছে?
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:২০
রেডিও জকি বা আর-জে ধারণাটি এক সময় তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছেই বেশ ট্রেন্ডি একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ইউটিউবসহ নানা ধরনের বিনোদনের উৎস হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন। এফএম রেডিওর সেই জনপ্রিয়তায়ও যেন ভাটা পড়েছে। আর-জে হয়ে ওঠার ঝোঁক তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন কতটা রয়েছে?
অনেকেই কেন সরে যাচ্ছেন
আর-জে অথবা রেডিও জকি হতে চান ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থী তাসকিন জাহান। কিশোর বয়স থেকেই সেই ঝোঁক তার।
তিনি বলেন, "ছোট বেলা থেকেই কথা বলতে ভাল লাগে। আমার শ্রোতা থাকবে, তাদের সাথে আমি সুন্দর করে কানেক্ট করবো, কথা বলতে পারবো। সেখান থেকেই ভাল লাগা। আর ছোট বেলায় অন্য রকম একটা ব্যাপার লাগতো যে কাউকে না দেখে কারো গলা শুনেই কাউকে ভালবাসা যায়, এটা আমার খুব ভাল লাগতো।" কিন্তু একই বিষয়ে আগ্রহী বন্ধুদের অনেকেই বেশ ব্যস্ত হয়ে গেছেন লেখাপড়ার চাপে।
তাসকিন আর-জে হয়ে হয়ে উঠতে পারবেন কি না সেটি তিনি জানেন না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রেডিও স্টেশনে নিয়মিত শখের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।
একরকম ঝোঁকের বসেই একটি আর-জে ট্যালেন্ট হান্টে অংশ নিয়েছিলেন সোনিয়া আফরিন ঈশিতা। কিন্তু এখন সরে এসেছেন এবং একটি বেসরকারি টেলিভিশনে উপস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন।
এই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলছিলেন, "এখন মানুষের হাতে হাতে ইউটিউব চলে এসেছে। ফোন এত বেশি সহজলভ্য এখন, রেডিওর যে জনপ্রিয়তা ছিল সেটা কমে যাওয়া শুরু করলো। এজন্য মনে হল যে সুইচ করি। তাই রেডিও থেকে টিভিতে আসা।"
যেভাবে জনপ্রিয় হল রেডিও জকির ধারণা
রেডিও জকির ধারণাটি বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল দেশটির প্রথম বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশন- রেডিও টুডে। কিন্তু আর-জে ধারণাটিকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায় আর একটি স্টেশন রেডিও ফুর্তি। ২০০৬ সালে এই দুটি এফএম রেডিও স্টেশন দিয়ে শুরু। কয়েক বছরের মধ্যে আরও বেশ কিছু এফএম রেডিও চালু হল।
আর-জে ধারণাটিও তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করলো ধীরে ধীরে, যার মাধ্যম ছিল সেসময় আর-জে যারা ছিলেন, তারা।
বাংলা আর ইংরেজি মিলিয়ে তাদের কথা বলার স্টাইল নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও তরুণ প্রজন্মের অনেকেই তাদের আবেগ ও ভাষার সাথে একাত্ম হতে পেরেছিলেন এবং আর-জে হতে চেয়েছেন।
এই পেশায় টিকে আছেন এমন একজন, রেডিও ফুর্তির শারার শামস, আর-জে শায়র হিসেবে যার পরিচয়। তিনি মনে করেন মাইক্রোফোনের পেছনে থাকার চেয়ে ক্যামেরার সামনে থাকায় এখন তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বেশি।
"এখন এমন একটা যুগ যে সবাই কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হতে চায়। এটা একটা নতুন বিষয়, যার সাথে আমরা পরিচিত হচ্ছি। আমরা মেইনস্ট্রিম আর্টের সাথে পরিচিত ছিলাম- যেমন কেউ গান করে, নাচ বা অভিনয় করে। এখন নতুন এক ধরনের বিনোদন, কন্টেন্ট ক্রিয়েটিং। এতে অনেক কিছু করা যায়। কোন কিছুর রিভিউ থেকে শুরু করে, রান্না, ভ্রমণ, স্কিট করে অনেকে। সবাই এখন ক্যামেরার সামনে থাকতে চায়।" তবে তিনি মনে করেন শুধু মাইক্রোফোন অনেক শক্তিশালী, যা এখনই হারিয়ে যাবে না।
বিজ্ঞাপনের আকাল, এফএম রেডিওর পড়তি
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে সম্প্রচারে এসেছিলো ২২টি বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশন। সবগুলো সফল হয়েছে বলা যাবে না। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি রেডিও স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এসব স্টেশনে রেডিও-জকি'র কাজ পাননি আলফি শাহরিন।
তিনি বলছেন, "আমাদের ক্যাম্পাসে একটি রেডিও স্টেশন ছিল। আমি সেখানে দীর্ঘদিন স্টেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছি। আর-জে হওয়ার জন্য কোর্স করেছি। এটা আমার শখ ছিল বলতে পারেন। পরবর্তীতে আর ওই প্রফেশনে যাওয়া হয়নি। আমি অনেকগুলো রেডিও স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। ওরা ওই সময় সার্কুলার দিচ্ছিল না বা লোক নিচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও যখন দেখছিলাম যে হচ্ছে না, তো আমি মুভ করে ফেলেছি।" আলফি শাহরিন এখন একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।
আর এটিই তরুণ প্রজন্মের আর-জে হয়ে ওঠার ঝোঁক কমে যাওয়ার মূল কারণ বলে মনে করেন রেডিও ভূমি'র স্টেশন চিফ শামস সুমন। তিনি বলছেন, বেসরকারি রেডিওগুলোতে বিজ্ঞাপনের আয় কমে যাওয়ার কারণে তারাও কর্মীদের পর্যাপ্ত বেতন দিতে পারছেন না, যা তরুণদের নিরুৎসাহিত করছে।
তিনি বলছেন, "রেডিওর যে বিশাল মার্কেট ছিল সেটি এখন ক্ষয়িষ্ণু। তার কারণটা হচ্ছে কর্মী সংকট। রেডিও স্টেশনগুলো কর্মীদের সেভাবে সম্মানী দিতে পারছে না। তাই মেধাবীরা আগ্রহী হচ্ছে না।"
স্টেশনগুলো কেন সঠিকভাবে কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "বিজ্ঞাপনের মার্কেট ছোট। বিজ্ঞাপনদাতারা আর কেউ মনে করছে না যে এটা আর কেউ শুনছে।"
কিন্তু এর কোনটাতেই দমে যাচ্ছেন না তাসকিন জাহান। ক্যাম্পাসের রেডিওতে সপ্তাহে ১৫টি প্রোগ্রাম করছেন। নিয়মিত কর্মশালাতে অংশ নিচ্ছেন। তবে ব্যবসায় প্রশাসন থেকে আর-জে হয়ে ওঠায় অভিভাবকরা কতটা সায় দেবেন সেটি এখন তার প্রধান চিন্তা। সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।