শোকাবহ জেল হত্যা দিবস আজ
ডেস্ক রিপোর্ট | প্রকাশিত: ৩ নভেম্বর ২০২০, ১৪:১০
নিজস্ব প্রতিবেদক:
এক ভয়াল-বীভৎস্য দিনের নাম ৩ নভেম্বর। বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের আরেক ভয়ঙ্কর দিন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেদনাবিধুর কলঙ্কিত দিন। রক্তক্ষরা জেলহত্যা দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের যে কটি দিন চিরকাল কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি ৩ নবেম্বর। যে ক’টি ঘটনা বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত অর্জনের পথে বাধা তৈরি করেছে, তার মধ্যে একটি ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের এ দিনে।
তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী- এই চারটি নাম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ চারজনকে বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিটি আন্দোলনে, গণআন্দোলনে ও সংগ্রামে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিসীম ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর কালরাতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাটতেরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু, পাল্টা ক্যু’র রক্তাক্ত অধ্যায়ে মানবতার শত্রু ও বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ওই একই পরাজিত শক্তির দোসর বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। সেই থেকে প্রতি বছরের মতো এ দিনটি জেলহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
বাঙালী জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ জাতির চার সূর্যসন্তান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন কারান্তরীণ দেশমাতৃকার সেরা সন্তান এই জাতীয় চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়েছিল। বাঙালীকে পিছিয়ে দিয়েছিল প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রমিছিল থেকে। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব।
জেনে নেই কী ঘটেছিল সেই রাতে:
ভোর তখন প্রায় ৪টা। বাইরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর লোকজন ট্যাংক নিয়ে পুরো ঢাকায় মহড়া দিচ্ছে। সেসময় বঙ্গভবনে একটি ফোন বেজে ওঠলো। ফোনটি ধরলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি শাহরিয়ার রশিদ খান। রশিদের ভাষায়- টেলিফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে এক ভারী কণ্ঠে বলছে, আমি ডিআইজি প্রিজন কথা বলছি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমি আলাপ করতে চাই। রশিদ খন্দকার মোশতাককে টেলিফোনটি দিলে, তিনি কিছুক্ষণ ধরে কেবল হ্যাঁ, হ্যাঁ করতে থাকনে। তার কথা পরিষ্কার বুঝা না গেলেও যেকোনো ব্যাপারেই হোক তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন।
টেলিফোনে যখন আলাপ শেষ হলো তখন ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য রিসালদার মুসলেহউদ্দিন তার দলবল নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশের অপেক্ষায়। কারাগারের ঢুকা নিয়ে ডিআইজি প্রিজনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শেষে রাষ্ট্রপতির অনুমতি সাপেক্ষে কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বাজে ভোর সাড়ে ৪ টা।
তাজউদ্দিন আহমেদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম কারাগারের একটি সেলেই ছিলেন। মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান ছিলেন পাশের সেলে। তাদেরকে একত্রিত করে তাজউদ্দিনের সেলে আনা হয়। একত্রিত অবস্থায় খুব কাছ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে তাদেরকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। জাতীয় চার নেতাকে একত্রে গুলি করা হলে তিনজন সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাজউদ্দিন আহমেদের পায়ে ও পেটে গুলি লাগার কারণে তিনি গুলির পরও অনেক সময় বেঁচে ছিলেন। রক্তক্ষরণের ফলে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পরে মারা যান।
পাশের সেলে কারাবন্দিরা জানিয়েছিল, গুলির পরও প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে একজনের আর্তনাদ শুনেছিলেন তারা। আর ‘পানি, পানি’ বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাঁতরানোর মর্মভেদী শব্দ তাদের কানে আসছিলো। কিন্তু বর্বর ঘাতক মুসলেউদ্দিন গ্যাং চলে যাবার আগে সেলটিকে খুব শক্তভাবে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়ায় মৃত্যুর আগে তাজউদ্দিন আহমেদের মুখে এক ফোঁটা পানিও কেউ তুলে দিতে পারেনি। ওই পিপাসা নিয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাজউদ্দিন আহমেদ।
বাঙালী জাতি রচনা করে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতির বীর সন্তনদের অকৃতিম সাহস আর বুকের তাজা রক্ত সবুজ জমিনে ঢেলে দিয়ে যে বাংলাকে শুত্রু মুক্ত করেছিল। ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিল স্বাধীন ভূ-খন্ড। সেই স্বাধীন দেশে আর যেন এমন কলঙ্কময় অধ্যায় না হয়; সব কলঙ্ককে ধুয়ে মুছে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলা গড়ে উঠবে সেই প্রত্যাশা গোটা জাতির।
এনএফ৭১/আরআর/২০২০
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।