আগামী নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে

জাতিসংঘের আয়োজিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সম্মেলনে যোগ দিতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে কাতারে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সম্মেলনের ফাঁকে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক নিক ক্লার্ক প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেন। শনিবার (১১ মার্চ) সাড়ে ১০টায় এটি সম্প্রচার হয় আলজাজিরায়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচন শতভাগ নিরপেক্ষ হবে। আগের দুই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, তারা কোনো কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল এবং মানুষ আমার দলের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। কেন? কারণ, তাদের দলের নেতারা দুর্নীতি, অস্ত্র পাচার, গ্রেনেড হামলার মতো অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত।

সরকারপ্রধান বলেন, কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা খারাপ। বিএনপিই এই প্রক্রিয়া ধ্বংস করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগের দুই নির্বাচন নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছে ঠিকই, তবে প্রমাণ করতে পারেনি। এবারও শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিযোগ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে আমরা ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ অব্যাহত গণতন্ত্রের মধ্যে রয়েছে, সে জন্যই দেশের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।

অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে কারা ছিলেন, এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল; তারা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই করেনি, তারা মানুষকে হত্যা করেছে, আমাদের দেশকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। সে সময় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আমাদের দেশের নাম পাঁচবার এসেছে। অন্য অনেকের মতো আমিও ভুক্তভোগী হয়েছি।

পশ্চিমা গণমাধ্যমকে প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম যারা আমাকে স্বৈরাচারী শাসক বলে, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যখন আমার দেশে সেনা শাসন ছিল, তখন এটিকে আপনারা কীভাবে বিচার করবেন?

দেশের উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখেছি। এতে দেশে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে, জিডিপি বাড়ছে। আমার বাবা বেঁচে নেই, কিন্তু আমি তার আদর্শ অনুসরণ করি। আমি চেষ্টা করি, তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন, সেভাবেই দেশের মানুষের সেবা করছি। এ কারণেই ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, তারা আমাকে একাধিকবার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে (২১ আগস্ট) তারা আমার ওপর হামলা চালিয়েছে। নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ আমার দলের ২২ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি এ নিয়ে কোনও তদন্ত, এর কোনও বিচার পর্যন্ত হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু তা-ই নয়, তাদের (বিএনপি) দুর্নীতির বিষয় দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রমাণিত হয়েছে। এরপর তাদের সন্ত্রাসবাদ। দেশের পাঁচ শতাধিক স্থানে এক ঘণ্টার মধ্যে তারা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তাদের অপকর্মের জন্য তখন জরুরি অবস্থাও জারি হয়েছিল। আমি দেশের মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছি, আমি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমরা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হই। তবে এটি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা আমরা জানি। এ বিষয়ে আমাদের সব প্রস্তুতিও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। যেকোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে সহায়তা করার জন্য ৮৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণও দিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদ নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের মানুষ দুর্দান্ত। আসলে যেকোনও কাজেই আমরা কয়েক ধাপে পরিকল্পনা করি। দীর্ঘমেয়াদি, স্বম্পমেয়াদি এমনকি তাৎক্ষণিকভাবেও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এভাবে আমরা পরিকল্পনামাফিক দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

শেখ হাসিনা বলেন, এখন দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট আছে। সাবমেরিন ক্যাবল, ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে মানুষকে সারা বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করেছি। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছিলাম; এখন দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, যখন রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন শুরু হয়, রোহিঙ্গারা নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছিলৃতাদের প্রতি আমাদের মায়া কাজ করে। এরপর আমরা আমাদের সীমান্ত খুলে দেই, তাদের আসতে দেই। তাছাড়া মানবিক দিক চিন্তা করে আমরা তাদের বাসস্থান এবং চিকিৎসা দেই।পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও কথা বলতে থাকে বাংলাদেশ। তবে, দুঃখজনকভাবে তারা ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়নি। তাদের অবশ্যই নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর চাপ দিচ্ছে, কিন্তু এটি খুবই কঠিন। আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করেছি। ভাসান চর থাকার জন্য খুবই ভালো জায়গা। বাচ্চাদের জন্য আমরা খুবই সুন্দর বাড়ি এবং অসাধারণ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছি।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাম্প্রতিক আগুন নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। যে ঘটনায় প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা বাসস্থান হারিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আসলে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবস্থা খুব ভালো নয়। রোহিঙ্গারা একে-অপরের সঙ্গে মারামারি করছে। তারা মাদক, মানব ও অস্ত্র পাচারের মতো বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে।

এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর ইউক্রেন এবং ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের দিকে চলে গেছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

সাংবাদিক নিক ক্লার্ক প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন রোহিঙ্গাদের কাজ করার ব্যবস্থা বা সুযোগ করে দেবেন কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের অনেক সুবিধা দিলেও এটি তিনি করতে পারবেন না। কারণ সেখানকার স্থানীয় বাংলাদেশিরাই ভালো নেই। এছাড়া রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে থাকলেও, তারা অন্য দেশের নাগরিক। বাংলাদেশে হলো তারা শরণার্থী।

১৯৭৫-এ পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৮ জন স্বজন হারানোর কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, সংবিধান ক্ষুণ্ন করে, সামরিক আইন ক্ষুণ্ন সামরিক স্বৈরাচাররা ক্ষমতা দখল করে। সেখান থেকে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরাই দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়েছি। আমরা জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। কেবল তাই নয়, আমরা জনগণকে তাদের নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করেছি।

মানবাধিকার হরণের অভিযোগকে কিছু মানুষের মিথ্যে প্রচারণা আখ্যা দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এরা দেশের প্রগতি ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন চায় না। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, মানবাধিকার হরণ করার পরও কী করে আমরা দারিদ্র্য হ্রাস, জিডিপি, শিক্ষার হার বাড়াতে সক্ষম হলাম?

সাক্ষাৎকারটির শেষ অংশে প্রধানমন্ত্রী জানান তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে দেশ শাসন করছেন। আর বঙ্গবন্ধুর দোয়া থাকার কারণেই ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষদের সেবা দিয়ে যেতে পারছেন তিনি।