নির্বাচন নিয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা কি বললেন?
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৮ জানুয়ারী ২০২৪, ১৭:৪৮
০৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের ১২ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনকে ঘিরে সারা বিশ্বের চোখ ছিল বাংলাদেশের দিকে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের পর্যবেক্ষক দল পাঠায় বাংলাদেশে। তারা নির্বাচনের স্বার্বিক দিক পর্যবেক্ষণ করেন সারাদিন।
ভোটগ্রহণ শেষে রোববার বিকাল ৫টা থেকে ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ের মিডিয়া সেন্টারে পৃথকভাবে নিজেদের মত তুলে ধরেন সরকার ও নির্বাচন কমিশন আমন্ত্রিত এই পর্যবেক্ষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেস সদস্য জিম বেইটস বলেন, “বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে কম সময়ের ভোট হয়। এ কারণে যখন আমি শুনি, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কথা, তখন আমার কেবল ৮টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ভোট হওয়ার কথা মাথায় আসে।”
বাংলাদেশের ভোটের সময়কে কম হিসাবে অভিহিত করে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে আরও বেশি সময় ধরে ভোট হয় বলে জানান তিনি এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় এক মাস ধরে নির্বাচন হওয়ার কথা তুলে ধরেন এই মার্কিনি।
এসময় তিনি আরও বলেন, “আমি যেটা পেয়েছি, খুব শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যখন আমি দেখি, বিরোধী দল প্রত্যাহার করে নেয়, এই দল একবার ঐ দল আরেকবার, দেশের ভালোর জন্য এক হয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি দেখে আমি অভিভূত।”
দ্বাদশ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা রাশিয়ার ৩ পর্যবেক্ষক দলের দলনেতা আন্দ্রে সুটভ বলেন, “আমরা বিভিন্ন স্থানের ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। সকল স্থানেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চোখে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো ছিল।”
ভোটের দিনের আগে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরে কানাডার সংসদ সদস্য চন্দ্রকান্ত আরিয়া বলেন, “সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অবাধ ও সম্পূর্ণ সুযোগ থাকার বিষয় আমরা খতিয়ে দেখেছি ও নিশ্চিত হয়েছি। “আমরাও এও জেনেছি, অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটারদের কাছে প্রচারণার সুযোগ ছিল কিনা, আমরা সেটাও দেখেছি।” কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই ভোটার ও নির্বাচনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন আরেক সংসদ সদস্য ভিক্টর ওহ।
বেলজিয়ামভিত্তিক সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের (এসএডিএফ) নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা আরিয়া বলেন, “সফলভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে আমরা অভিনন্দন জানাতে চাই।”
বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “ভোট বর্জন করা কোনো রাজনৈতিক দলের কৌশলগত সিদ্ধান্ত, সেটা তারা নিজেদের স্বার্থে করে থাকে। তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে মন্তব্য করা আমাদের কাজ নয়।”
নিজ দেশের তুলনায় ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি কম নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দুই বছর আগে কানাডার সবচেয়ে বড় প্রাদেশিক নির্বাচনে ৪৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল। মানুষ বলেছে উপস্থিতি কম, কিন্তু কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি। এক বছর আগে ফেডারেল নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। “ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে, কিন্তু দিনশেষে আমাদেরকে দেখতে হবে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দিয়েছে কিনা। সেটা দেখা যায়নি। মানুষ ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিল। রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত তারা ভোটে আসল কি, আসল না। ভোটের প্রক্রিয়াটা অবাধ ছিল, আমরা সেটাকে গ্রহণ করছি।”
১০ কেন্দ্রে গিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরে আমেরিকান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলেক্সান্ডার বি গ্রে বলেন, “আমার চোখে আমি যেটা দেখেছি, সেটা হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এমন নির্বাচন যেটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালনা করা হয়েছে, ভোটারদের মধ্যে অনেক উৎসাহের নির্বাচন। “নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ভোটগ্রহণ দেখে আমি ও আমার সহকর্মী সম্মানিতবোধ করছি। আমরা যেসব কেন্দ্রে গিয়েছি, সেখানে পেশাদারিত্বের উচ্চমান দেখেছি। নির্বাচন কমিশনকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে দেখেছি।”
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট দেখতে গিয়ে শান্তিপূর্ণ ও ভোটারদের আনন্দঘন উপস্থিতি দেখার কথা তুলে ধরেন নাইজেরিয়ার সিনেট সদস্য ইকরা বিলবিস আলিয়ু।
পরিদর্শনের জন্য কেন্দ্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “গুগল করেও সবসময় সঠিক জায়গাটি পাওয়া যায়নি। এ কারণে কেন্দ্রে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়েছি আমরা। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে আমরা কথা বলিনি।”
সোমালিয়া থেকে আসা আরব পার্লামেন্টের সদস্য আবদি হাকিম মোয়াল্লিম আহমেদ বলেন, “ব্যাপক অংশগ্রহণে আমরা অভিভূত, যাতে বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেওয়ার মৌলিক অধিকার চর্চা করেছে। আমরা এমন দক্ষভাবে নির্বাচনের পরিকল্পনা ও অনুষ্ঠানকে সাধুবাদ জানাই।”
তিনি বলেন, “এই নির্বাচনে স্বচ্ছ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রকৃতি অন্য দেশ অনুকরণ করতে পারে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সুশাসনের অনেক বড় ইতিহাস রয়েছে। আমাদেরকে এমন অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এবং ভোট পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে সাধুবাদ জানাই।”
বেলজিয়ামভিত্তিক সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের (এসএডিএফ) নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে।
বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, ভোটারদেরকে বাছাইয়ের সুযোগ কমিয়ে দেওয়া এবং কম ভোটার উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে জনগণের মতের প্রতিফলন হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, এতে সন্দেহ নাই।”
বিবিসিসহ অন্য অনেক গণমাধ্যমের খবর তেমন ভারসাম্যপূর্ণ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিরোধী দল চায় তারা এমন নির্বাচনে অংশ নেবে, যাতে সরকারকে চলে যেতে হবে। এটা আবার কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেবল রয়েছে শুধু পাকিস্তানে।
“এটা ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানে আবিষ্কার হয়েছে। একবার-দুইবারের জন্য এটা ভালো হতে পারে, কিন্তু মৌলিকভাবে এটা গণতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা। বিরোধীদল যেটা চাচ্ছে, সেটা অসাংবিধানিক। এটা না হলে তারা হরতাল-অবরোধ দিচ্ছে। তারা হয়ত বলছে বাসে-ট্রেনে আগুন দিচ্ছে না। কিন্তু কেউ না কেউতো দায়ী।”
২০১৩ সালে এসে বার্ন ইউনিটে গিয়ে পোড়া মানুষ দেখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা হতে পারে না। আমাকে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগও তাই করেছে। কারা কি করেছে, আমি জানি না। কিন্তু এটা উত্তর হতে পারে না। আমাদেরকে এই সহিংসতার যুক্তি পরিহার করতে হবে।”
তিনি বলেন, “গণতন্ত্র হচ্ছে বাছাই করার সুযোগ ও মেরুকরণ। কিন্তু সেই মেরুকরণ বিষাক্ত মেরুকরণ নয়। মানুষকে কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হতে হবে। এটা যদি তারা না করে, তাহলে সেটা বেশ কঠিন।”
গণতন্ত্র যদি বাছাই হয়, তাহলে এই নির্বাচনে বাছাইয়ের সুযোগটা কোথায়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “প্রধান বিরোধীদল ভোট বর্জন করে বাছাই করার সুযোগ নষ্ট করেছে, এটা দুর্ভাগ্যের। (বাছাইয়ের সুযোগ কমের) এই নেতিবাচক দিকের জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে উৎসব ও অংশগ্রহণের দিকটি রয়েছে।”
নানা বয়সী ভোটারের উপস্থিতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে ওআইসির প্রতিনিধি শাকির মাহমুদ বান্দার বলেন, “ওআইসির বক্তব্য হচ্ছে, এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সহযোগিতা দেওয়ায় আমরা বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে সাধুবাদ জানাই। এবং নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠানে অভিনন্দন জানাই।”
দ্বাদশ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা রাশিয়ার ৩ পর্যবেক্ষক দলের দলনেতা আন্দ্রে সুটভ বলেন, “আমরা বিভিন্ন স্থানের ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। সকল স্থানেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চোখে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো ছিল।”
স্কটিশ পার্লামেন্টের সদস্য মার্টিন ডে বলেন, “এই প্রথম আমি বাংলাদেশে এসেছি। ভোটের প্রক্রিয়া দেখেছি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ভোট হয়েছে কিন্তু ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।”
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।