আজ বিশ্ব মা দিবস
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৪, ১৪:১৯
মা আমাদের অস্তিত্বের নাম:
মা ছোট্ট একটি শব্দ কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ডাক। ছোট্ট এ শব্দের অতলে লুকানো থাকে গভীর স্নেহ, মমতা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা। সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর পরম আশ্রয়ের নাম মা। মায়ের মমতায়, ভালোবাসায়, আদরে-যত্নে লালিত হতে থাকে ছোট্ট শিশুটি।
মা আমাদের অস্তিত্বের এক অপরিহার্য অংশ। শত বিপদ-আপদ থেকে মা তার সন্তানকে আগলে রাখেন। চেখের আড়াল হলেই সন্তানের জন্য মায়ের চিত্ত যেন উদগ্রীব হয়ে থাকে সবসময়। তাই একজন সন্তানের জীবনে মায়ের ঋণ কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করা যায় না।
মায়ের কষ্ট আর সীমাহীন বেদনায় ফসল হিসেবে প্রতিটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে। একজন মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ থেকে শুরু করে আমৃত্যু নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসেন। মায়ের এই ভালোবাসা একটি অনবরত স্রোত যেখানে কখনও ভাটা পড়ে না।
পৃথিবীতে যদি কেউ নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারেন, তিনি হলেন মা। দুঃখে ও সুখে প্রতিটি সময় যিনি স্নেহ ভালোবাসায় পাশে থাকেন, তিনি হলেন মা। আর মায়ের ভালবাসা পেতে কখনো প্রয়োজন হয় না ভালবাসি বলা।
শৈশব থেকে আনন্দ-বেদনা-ভয় কিংবা উদ্দীপনা- প্রতিটি মানবিক অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকে মায়ের নাম। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সবশেষ আশ্রয়স্থল মা নামের ওই মমতাময়ী নারীর আঁচল।
শুধু মানব জাতিই নয়, ধরিত্রীতে বিরাজমান প্রায় সকল প্রাণীদের মাঝেই দেখা যায় মাতৃত্বের অনন্য নিদর্শন। যা সভ্যতার মানদণ্ডের উর্ধ্বে উঠে ঘোষণা করে মাতৃত্বের বিশালতা। প্রকৃতিতে ভালোবাসার স্নিগ্ধ স্রোতধারার নাম মাতৃত্ব।
আজ পৃথিবীর সেই সকল মমতাময়ীর সম্মানে বিশ্ব মা দিবস। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বব্যাপী বিশেষ মর্যাদায় পালিত হয় দিনটি। আসলে মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দিনক্ষণের প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি মায়েরই সন্তানের ভালোবাসা প্রাপ্য প্রতিদিনই। তবুও দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে যে মা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান, নিজের সব স্বাদ-আহ্লাদ সন্তানের নামে করে দেন যে মা, তার সম্মানে আলাদা করে একটু ভালোবাসা জানাতেই আজকের দিনটি।
সৃষ্টি হয়েছে বহু কালজয়ী শিল্পকর্ম:
মায়ের সঙ্গে সন্তানের আত্মিক বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরের। অটুট এ বন্ধনের প্রাগাঢ় আবেগে তাড়িত হয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে বহু গান, কবিতা, গল্প, আর উপন্যাস। সৃষ্টি হয়েছে বহু কালজয়ী শিল্পকর্ম। বাংলা সাহিত্যেও মাকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মনে পড়া, শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে, হুমায়ুন আজাদের ‘আমাদের মা, আল মাহমুদের ‘নোলক, কালিদাসের ‘মাতৃভক্তি এমনই কিছু কালজয়ী বন্দনা।
পৃথিবীর সকল যুগের সকল ধর্মে মা সম্মান রাখা হয়েছে সবচেয়ে উঁচুতে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার শোকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শোকরিয়া আদায় করো। (সুরা লোকমান, আয়াত: ১৪)।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় ‘মা ডাকের শব্দগুলোর মধ্যেও আছে উচ্চারণগত অদ্ভূত এক মিল। সবগুলো শব্দের শুরুই ‘এম অথবা ‘মবর্ণটি দিয়ে। জার্মান ভাষায় ‘মাট্টার, ওলন্দাজ ভাষায় ‘ময়েদার, ইতালিয়ান ভাষায় ‘মাদর, চীনা ভাষায় ‘মামা, প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় ‘মাত, সোয়াহিলি ভাষায় ‘মামা এবং আফ্রিকান, হিন্দি ও বাংলা ভাষায় ‘মা।
কীভাবে এই সাদৃশ্য ঘটল তা আজও এক বিরাট রহস্য। তবে ভাষাবিদ রোমান জ্যাকবসন এর পেছনে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, শিশুরা যখন তার মায়ের দুধ পান করে, তখন তারা তাদের মুখভর্তি অবস্থায় কিছু শব্দ করে। সেই শব্দগুলো নাক দিয়ে বের হয় বলে উচ্চারণগুলো অনেকটা ‘ম-এর মতো শোনা যায়। তাই প্রায় সব ভাষায়ই ‘মা ডাকে ব্যবহৃত শব্দগুলো ‘ম বা ‘এম দিয়ে শুরু হয়।
‘মা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘মম, যা পূর্বে ব্যবহৃত শব্দ ‘মাম্মার পরিবর্তিত রূপ। ধারণা করা হয়, ইংরেজি শব্দ মাম্মা এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘মাম্মা থেকে। যা ‘স্তন বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। এই শব্দ থেকে ‘ম্যামেল উৎপত্তি। যা কিনা স্তন্যপায়ী প্রাণীর ইংরেজি প্রতিশব্দ।
মা দিবসের সূচনা যেভাবে:
রোববার ১২ মে সারা বিশ্বব্যপী পালন করা হচ্ছে বিশ্ব মা দিবস। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় মা দিবস। জানা যায়, মা দিবসের সূচনা হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে। সেখানে প্রচলিত ছিল মাতৃরূপী দেবী সিবেল ও দেবী জুনোর আরাধনা। এছাড়া ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে প্রচলিত ছিল মাদারিং সানডের মতো বেশ কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠান। সবসময় মায়েদের সম্মানে মাদারিং সানডে পালিত হতো নির্দিষ্ট একটি রোববার।
তবে বর্তমানে প্রচলিত মা দিবসের সূচনা হয় ১৯০৮ সালে। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক স্কুলশিক্ষিকা অ্যানা রিভস জারভিস সেখানকার পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা দেখে মর্মাহত হয়ে মায়ের জন্য বিশেষ দিন পালনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করার কথা ভাবলেন। নিজের সেই মহৎ ভাবনা বাস্তবায়নের আগেই ১৯০৫ সালের ৯ মে মারা যান তিনি।
তার মৃত্যুর পর মেয়ে অ্যানা এম (মারিয়া) জারভিস মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেন। বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ১৯০৮ সালে তার মা ফিলাডেলফিয়ার যে গির্জায় উপাসনা করতেন, সেখানে সব মাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মা দিবসের সূচনা করেন। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মায়েদের জন্য উৎসর্গ করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন। এরপর থেকেই মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়ে থাকে।
মাকে নিয়ে বিখ্যাতদের উক্তি:
জীবনে মায়ের অবদান বোঝাতে বিখ্যাত ব্যক্তিরা নানা ধরনের উক্তি দিয়েছেন। নিচে তাদের উক্তিগুলো তুলে ধরা হলো- আমেরিকান লেখক মিচ আলবোম বলেছেন, মায়ের চোখে তাকালেই পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ আর নিখাদ ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাম লিঙ্কন বলেছেন, মা আমার কাছে দেবদূত। আমি যা হয়েছি কিংবা যা হতে চাই সব কিছুর জন্যই আমার মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ।
আব্রাহাম লিংকনের আরেকটি উক্তি রয়েছে- যার মা আছে সে কখনই গরীব নয়। অর্থাৎ কেবল মায়ের আশ্রয় থাকলেই বন্ধুর পথের নানা বিপদ পাড়ি দেওয়া যায় সহজেই।
ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ভাষায়, সব ভালোবাসার শুরু এবং শেষ হয় মার্তৃত্বে।
আমেরিকান ধর্মপ্রচারক এডউইন চ্যাপিন বলেছেন, পৃথিবীর কোনো শক্তি, সৌন্দর্য কিংবা বীরত্ব মায়ের ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়।
জার্মান-আমেরিকান সমাজ মনোবিজ্ঞানী এরিচ ফ্রম বলেছেন, মায়ের ভালোবাসাতেই শান্তি। এটা অর্জন করতে হয় না। এটার জন্য যোগ্যও হতে হয় না।
খ্রিস্টীয় প্রবাদে আছে, ঈশ্বর সব জায়গায় থাকতে পারে না, এ কারণে তিনি মাকে পাঠিয়েছেন।
আরেকটি প্রবাদে আছে, মা তার সন্তানদের হাত হয়তো কিছু সময়ের জন্য ধরে থাকেন কিন্তু তাদের হৃদয়ে থাকেন সারাজীবন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক লুসিয়া মে অরকটের ভাষায়, মা সব কিছু ক্ষমা করে দেন। পৃথিবীর সবাই ছেড়ে গেলেও মা কখনো সন্তানকে ছেড়ে যান না।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।