শেখ হাসিনার পতনের খবর আগেই জানত ভারত

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫১

ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হবে, তা তিনি নিজেও ধারণা করতে পারেননি। তবে তার পতন হবে এটা আগে থেকেই জানত ভারত। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন দাবি করেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক বিশেষ সচিব (জন-কূটনীতি) পিনাক রঞ্জন।

তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে এমন একটা ঘটনা ঘটবে; আমরা কি তা জানতাম। এমন প্রশ্ন আমাদের করা হলে আমরা উত্তরে বলব, আমরা অবশ্যই জানতাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা তার পতন সম্পর্কে অবগত ছিলেন কিনা। আমার মনে হয় যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে তিনি তা অনুমান করেননি, সম্ভবত আপনি যদি ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকেন তবে আপনি অনুভব করবেন যে সবকিছু ঠিকই আছে।

২০০৭-০৯ সময়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন পিনাক, যে সময়ে ঘটেছিল ১/১১ এর পটপরিবর্তন। তার আগে ১৯৯৯-২০০২ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কূটনীতি বিষয়ক সম্পাদক শুভজিৎ রায়কে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'সুপ্রিমকোর্ট কোটার অনুপাত ৭ শতাংশ করার পরে বিক্ষোভ প্রশমিত হবে বলে মনে করেছিলাম। এসব বিক্ষোভে চলাকালে ৩০০ জনের বেশি নিহত হয়। বিক্ষোভকারীরা তখন ৯ দফা দাবি নিয়ে ফিরে আসে। তারা কয়েকজন মন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগসহ অন্যান্য দাবি করে। যদিও কেন তারা এসব (দাবি) করেছে, তা একটি রহস্য।'

'এদিকে হাসিনা অবশ্যই তার মন্ত্রীদের বরখাস্ত করতে রাজি হননি, তখন তারা আবারো তাণ্ডব শুরু করে। এইবার অত্যন্ত কার্যকর একটি শক্তি তাদেরকে সমর্থন দেয়' - দাবি করেন তিনি।

ঢাকার ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে ১/১১ সময়ের একজন পরিচিত মুখ ছিলেন পিনাক। তিনি বলেন, 'আমার ধারণা এখানে অন্যান্য প্রভাবগুলো কাজ করেছে — যার বেশিরভাগ বিদেশি এবং কিছু ছিল অভ্যন্তরীণ।'

এটি এত রাজনৈতিক রূপ কেন নিল যে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠলো? – এমন প্রশ্নের জবাবে পিনাক রঞ্জন বলেন, 'এটাও একটা (গুরুত্বপূর্ণ) প্রশ্ন। আমি বলব, সেনাবাহিনী তাকে রক্ষা করতে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তারা (হাসিনাকে) জানিয়ে দেয়, আমরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করব না।'

পূর্ববর্তী বিএনপি–জামায়াত সরকারের সঙ্গে ভারতের সমস্যা ছিল নিরাপত্তা ইস্যু এবং পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সঙ্গে তাদের মৈত্রী। বিএনপি বরাবরই একটু ডানপন্থী এবং পাকিস্তানপন্থী। জামায়াত, অবশ্যই, সব সময় পাকিস্তানপন্থী ছিল, যদিও তারা এখন দাবি করে যে তারা আলাদা। বিএনপিও দাবি করে, তারা বদলে গেছে।

কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তিনি বলেছিলেন, তারা বাংলাদেশের মাটি ভারতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে দেবেন না। এই সবকিছু প্রত্যাশিত কাজ তিনি করেছেন। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেছেন যে বিদ্রোহীদের শিবির উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং (তাদের) হস্তান্তর করা হয়েছে। তাই সেই দিক থেকে হাসিনা আমাদের কাছে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যিনি নিরাপত্তার বিষয়টিতে (ভারতের চাহিদা) পূরণ করেছেন।

শেখ হাসিনা আরও বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা ভালো হবে। আমার মনে আছে, কীভাবে হাসিনা আমাকে প্রথম বলেছিলেন যে তার ভারত থেকে বিদ্যুৎ দরকার। এভাবেই গ্রিড সংযোগের প্রকল্প শুরু হয়।

আজ আমরা প্রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করি। আমরা ডিজেল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহ করার জন্য নুমালিগড় শোধনাগার থেকে উত্তর বাংলাদেশ পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপনের পরিকল্পনাও করেছি, যা নৌকা এবং অন্যান্য নদী দিয়ে চলাচলকারী কার্গোর জ্বালানি সরবরাহ করার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিকে সাহায্য করবে। এটি নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় নৌকা ও কার্গো সর্বত্রই যাতায়াত করতে পারে।

আমি মনে করি, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত এবং জ্বালানি ও খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী না হওয়া পর্যন্ত মানুষ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছে। তদুপরি, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভবত ন্যায়সংগত ছিল না। সৃষ্ট কর্মসংস্থান ছিল অপর্যাপ্ত এবং একটি তরুণ প্রজন্ম অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে। এ কারণে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।

কারণ, এই কোটা সরকারি কর্মসংস্থানে প্রবেশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ ছাড়া, নির্বাচনের সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, নতুন ভোটাররা মনে করেন যে তাদের হাতে অপশন থাকছে না (পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের অধিকার তাঁরা পাচ্ছেন না)। সেটাও ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি চালু হয়। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন—তাদের কিছু অগ্রাধিকার দেওয়ার। এরপর তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা নির্ধারণ করা হয়। বছরের পর বছর ধরে চলার পর সেই প্রজন্ম যখন অতীত হয়ে গেছে, তখন তাঁরা দাবি করলেন যে কোটা অব্যাহত রাখতে হবে এবং তাদের সন্তানদের ও পরে তাঁদের নাতি–নাতনিদের দিতে হবে।

এই মতবিরোধের সূত্রপাত তখনই হলো যখন দেখা গেল, সংখ্যালঘু, নারী ইত্যাদির জন্য কোটা রাখলে মোট কোটা প্রায় ৫৬ শতাংশে পৌঁছায়। ২০১২ সালে প্রথম কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং বাতিল করার জন্য একটি সরকারি আদেশও জারি করেছিলেন। কিন্তু কোটার সুবিধাভোগীরা পরে সেই আদেশ চ্যালেঞ্জ করেন। এরপর হাইকোর্ট সেই আদেশ স্থগিত করেন এবং তখনই আবার আন্দোলন শুরু হয়।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বিভিন্ন ধরনের লোক নিয়ে গঠিত। সেখানে রয়েছেন উগ্র ডানপন্থী দল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একজন নেতা। এরপর আছেন বিএনপির সহানুভূতিশীলেরা। এবং তারপর, অবশ্যই, অধ্যাপক ইউনূস আছেন, তিনি একজন বড়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আমি বলব, তিনি অত্যন্ত হাসিনাবিরোধী এবং তিনি (হাসিনা) তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা করেছেন। যেমন—অর্থ আত্মসাতের মামলা।

আমার চিন্তা হলো, তারা (সরকারের বিভিন্ন বিভাগ) একসঙ্গে কাজ করতে পারবে কি? এরা সবাই সরকারকে বিভিন্ন দিকে টানতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদে দুজন ছাত্রনেতা রয়েছেন এবং স্পষ্টতই, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে তদারকির জন্য দুজন ছাত্র নিযুক্ত রয়েছেন। অবশ্যই, কিছু ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, আমাদের অবশ্যই দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেছেন যে তিনি চাইবেন বাংলাদেশ সাউথ–ইস্ট এশিয়ান নেশনস অ্যাসোসিয়েশনে (আসিয়ান) যোগ দেওয়ার সুযোগ পাক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা আপনাকে পীড়া দেবে। সব জিনিস আগের অবস্থাতেই রয়েছে: হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত তাদের আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি–জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পরও একই ঘটনা ঘটেছিল।

শেখ হাসিনা আগেও এখানে ছিলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ছিলেন। যখন তার পুরো পরিবারকে রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি আবার এসেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে? আমি বলব, আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। তাঁরা এমন কোনো দল নয় যে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।

তাহলে কি হাসিনা ফিরে যাবেন? তাকে মামলা ও তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে এবং তারা তাকে জেলে পাঠাতে পারে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যা করা হয়েছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি নতুন নেতা তৈরি করবে? এসবই কেবল সম্ভাবনার কথা। হাসিনা এখানে থাকবেন কি না, সেটা তার বিষয়। আমি মনে করি না, ভারত সরকার তাকে বের করে দেবে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top