রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

বামদের ‘লাল সন্ত্রাস’-এর প্রতিবাদে মধ্যরাতে ঢাবিতে বিক্ষোভ

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭:২৯

ছবি: সংগৃহীত

এনসিটিবির সামনে উপজাতিদের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গত শুক্রবার রাতে এসব সমস্যার সমাধানে ‘লাল সন্ত্রাসই একমাত্র উপায়’ বলে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মেঘমল্লার বসু।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এদিন গভীর রাতে শিক্ষার্থীরা লাল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ শুরু করেন। ২৪ ঘন্টার মধ্যে বসুকে গ্রেফতারের দাবি তুলেন শিক্ষার্থীরা। এতে অংশ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও।

শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে ইংরেজী বার্তায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বসু লিখেন, একমাত্র বিকল্প লাল সন্ত্রাস। প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে প্রতিরক্ষামূলক সহিংসতা। আমরা জাগরণ এবং মিছিল করি যার সহিংস হওয়ার ক্ষমতা নেই। তা দ্বারা আপনি কখনই আপনার কমরেডদের রক্ষা করতে পারবেন না। মানুষ আপনাকে পছন্দ করবেন ঠিকই, কিন্তু কেউ অনুপ্রাণিত হবে না। কারোরই আর ‘মুক্তমনা’ পার্টির দরকার নেই। শহীদদের কেউ পরোয়া করে না। ফ্যাসীবাদ তখনই ভালো যখন সে মৃত।

তিনি ডানপন্থাকে ইঙ্গিত করে আরও বলেন, এই ডানপন্থীদের পাগলামিতে আপনাকে সার্বভৌমত্বের নামে হত্যা করা হবে এবং আপনার চরিত্রকে হত্যা করা হবে। মুক্তমনা এবং কেন্দ্রবাদী যারা তাদের হৃদয় তারা ডানপন্থার কাছে বিক্রি করেছে। তারা দাবি করবে এটি একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং উভয় পক্ষই কতটা খারাপ। আপনাদের খুব কম বন্ধুই আছে। এমনকি একজনকেও হারানোর সামর্থ্য আপনাদের আর নেই। আর মানুষ ভেড়ার মত। আপনি কি আজীবন মেষপালক হতে ইচ্ছুক?

গুপ্তরাজনীতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, প্রকাশ্য বিক্ষোভ করা বন্ধ করুন। প্রকাশ্যে কমিটি দেয়া বন্ধ করুন। আমরা সতর্ক না হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। দাঁত ও নখর বেরিয়ে আসছে। এভাবেই আপনার পথকে আপনি ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ থেকে বাঁচাতে পারবেন। আসুন এটিকে আমাদের গুপ্ত বন্ধুদের কাছে নিয়ে যাই। আমাদের সাথেই থাকুন।

বসুর এমন মন্তব্য সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন নেটিজেনরা। এ মন্তব্যের জেরে গভীর রাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাবি ক্যাম্পাস। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের থেকে আসে নানান ধরনের প্রতিবাদ। গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পাড়া থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমবেত হয় একদল শিক্ষার্থী। এসময় ‘লাল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন’, ‘উদ্দ্যানের গাঁজাখোর উদ্যানে ফিরে যা’,‘সন্ত্রাসীদের ঠিকানা এই ক্যাম্পাসে হবে না’, ‘জঙ্গি বসুর ঠিকানা এই ক্যাম্পাসে হবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দেয় তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মাহিন সরকার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।

সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট রাইটস ওয়াচ নামের একটি প্লাটফর্মের নেতা ও ঢাবি শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ বলেন, এরা ৮০ ও ৯০ এর দশকের মতো আবারও সন্ত্রাসবাদ কায়েম করতে চায়, তারা ডাকসুকে এভাবেই ভন্ডুল করেছিল ৯০ এর দশকে। আজ ওই সন্ত্রাসীরা আবারও সন্ত্রাসবাদের ঘোষণা দিচ্ছে। এই সন্ত্রাসীকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার করতেই হবে।

আজিজুল হক নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এই সংগঠন আওয়ামী লীগের বি টিম হিসাবে কাজ করেছে। ছাত্রলীগ ছাত্রদল-শিবিকে দমন করেছে কিন্তু এদেরকে জায়গা দিয়েছে। নতুন এই বাংলাদেশে বলতে চাই নতুন করে কাউকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে দেয়া হবে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, আমরা যখন ক্যাম্পাসে এসেছি সন্ত্রাসীরা একমাত্র এইসকল বামদেরকে জায়গা করে দিয়েছে। জুলাইয়ের মতো একটি বিপ্লবের পর এখনো দেখছি তারা আওয়ামী ন্যারেটিভকে শক্তিশালী করতে চায়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ে লাল সন্ত্রাসের হাত ছিলো। এদেরকে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে লাল সন্ত্রাসী মেঘমল্লার বসুকে গ্রেফতার করতে হবে।

শনিবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু গতকাল ফেসবুক পোস্টে বিরোধী মত দমনে ‘রেড টেরর’ ও সহিংসতার হুমকি দেন।

পোস্টে তিনি লাল সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক সহিংসতার প্রবর্তনের কথা বলেছেন, যা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ফেসবুক পোস্টে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে যারা গণতান্ত্রিক পথে প্রতিবাদ করছে তারা সহিংসতার শিকার হতে পারে এবং যারা রাজনীতি ও মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিবাদ চালানোর।”

জুবায়ের বলেন, ‘এই পোস্টের প্রতিবাদে এবং মেঘমল্লার বসুর গ্রেপ্তারের দাবিতে গত রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এমতাবস্থায় আমরা আশঙ্কা করছি ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্যাম্পাসে সংঘাত সৃষ্টি করে নির্বাচন প্রক্রিয়া বানচাল করার একটি চক্রান্ত করা হচ্ছে, যা মেঘমল্লার বসুর পোস্টে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

তিনি আরো বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থী গণতান্ত্রিক উপায়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন তারা শঙ্কা অনুভব করছেন যে তাদের দমন করতে অতীতের ন্যায় আবার এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।

কারণ আমরা ইতিহাসে দেখেছি এই লাল সন্ত্রাসীরা কিভাবে ভিন্নমতের মানুষকে বীভৎসভাবে খুন করেছে। সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি যে শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে অনতিবিলম্বে লাল সন্ত্রাসের উসকানিদাতা ও পর্দার আড়ালের কুশীলবদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় নিয়ে আসুন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবন এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সহিংসতার হুমকিদাতা মেঘমল্লার বসুকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হোক এবং আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’

লিখিত বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি যে এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের একটি সংঘাতের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে চায়।

তাদের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ভুলণ্ঠিত করা। কারণ তারা জানে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফরম ডাকসু নির্বাচন হলে তাদের আগের মতো অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ কমে যাবে। সে জন্য তারা ডাকসু নির্বাচনকেও বানচাল করে দিতে চায়। তাদের রেড টেররের পরিকল্পনা এবং প্রকাশ্যে দেওয়া ঘোষণা এই বার্তাই দেয়।’

জুবায়ের বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে চলা সংঘাতময় পরিস্থিতির পেছনে এই লাল সন্ত্রাসীদের নীলনকশা ও ইন্ধন রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখুন। কারণ আমরা দেখেছি সন্ত্রাসীরা কিভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে রক্তাক্ত করেছে।

পুলিশকে ডিঙিয়ে এই সংঘাতের ইন্ধন দিয়েছেন কিছু বাম নেতা। অনতিবিলম্বে এসব ইন্ধনদাতাসহ সব হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করে কঠোর বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে ক্যাম্পাস নিকটবর্তী এলাকায় পুলিশি হামলার সঙ্গে জড়িতদেরও কঠোর বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’

জুবায়ের আরো বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এবং ক্যাম্পাসের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে অনতিবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন দিতে হবে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের টালবাহানা সহ্য করা হবে না। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ডাকসু নির্বাচন হলে ক্যাম্পাস থেকে সকল ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান ঘটবে ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার ধারা ফিরে আসবে।’

সংবাদ সম্মেলনে জোবায়ের কমিউনিস্ট রাজনীতির অন্যতম আলোচিত নেতৃত্ব মাওবাদী নেতা সিরাজ শিকদারের গ্রাফিতি মুছে দেওয়ার ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী একটি মাওবাদী পার্টি। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পথ হিসেবে পার্লামেন্টারি পথ বর্জন করে গ্রামভিত্তিক দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের রাজনীতি গ্রহণ ও গোপন পার্টি গঠন করেন। বাংলাদেশের মধ্যে এই পথটা পরিত্যাজ্য।

গোপন ও সশস্ত্র বিদ্রোহ করে গুটি কয়েক মানুষের মাওবাদী আইডিওলজি প্রতিষ্ঠা করলে সাধারণ জনগণের সঙ্গে বেঈমানি হবে। লাইব্রেরির দেয়ালে সিরাজ শিকদারের গ্রাফিতি একই রকম চেতনার অবতারণা করতে পারে ও কালকে মেঘমল্লারের নানা সন্ত্রাসের ভ্যালিডিটি সিরাজ শিকদারকে কেন্দ্র করেই আবির্ভূত হতে পারে বিধায় প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা তার গ্রাফিতি মুছে দেয়।

সংবাদ সম্মেলন শেষে শাহবাগ থানায় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে লাল সন্ত্রাসের হুমকিদাতা মেঘমল্লার বসুর বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার ঘোষণা দেন তিনি।

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top