ট্রান্সজেন্ডার ও থার্ডজেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য কী?

'শরীফ থেকে শরীফার গল্প' বিতর্কে তোলপাড় দেশ

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারী ২০২৪, ১৮:২৩

ছবি: সংগৃহীত

ট্রান্সজেন্ডার কিংবা থার্ডজেন্ডার। এই ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে বিতর্ক, আলোচনা। অনেকেই বুঝে কিংবা না বুঝেই অংশ নিচ্ছেন সমালোচনায়। যাইহোক বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক দেশজুড়ে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ধারণা পরিষ্কার করতে চলুন প্রথমে জেনে আসি সেক্স ও জেন্ডারের পার্থক্য কী?

সেক্স ও জেন্ডারের পার্থক্য:

সমাজবিজ্ঞানী অ্যান ওকলের মতে, সেক্স শারীরিক বৈশিষ্ট্য বহন করে আর জেন্ডার একটি নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত। একটি সমাজে একজন ব্যাক্তির আচার-আচরণ কেমন হবে, তার পোশাক-পরিচ্ছদ কী হবে, সমাজে তার ভূমিকা কী হবে, মানসিক গঠনের দিক দিয়ে একজন ব্যাক্তি কেমন হবে তা জেন্ডার নির্ধারণ করে।

মূলত জেন্ডারের মাধ্যমে একজন ব্যাক্তির পরিচয় সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্মিত হয়। যেমন- বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিতভাবে নারীর ভূমিকা গৃহে কাজ করা, সন্তান লালন-পালন করা। অন্যদিকে আয় উপার্জন, বিচার, সালিস, রাজনীতি ইত্যাদি বাইরের কাজ হলো পুরুষের।

আবার বাংলাদেশে বসবাস করা গারো জনগোষ্ঠীদের ক্ষেত্রে তারা মাতৃতান্ত্রিক। নারীরা পরিবারের প্রধান এবং পরিবারে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই জেন্ডার পরিবর্তনশীল। একেক সমাজে জেন্ডার একেক ভূমিকা নির্মাণ করে।

ফলে আমাদের মনে রাখতে হবে, জেন্ডার কিন্তু সেক্সের পরিণতি নয় অর্থাৎ আপনি পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু পুরুষ বলে আপনি গৃহের কাজ করতে পারবেন না বা সন্তান-লালন পালন করতে পারবেন না এমন কোনো কথা নেই।

অন্যদিকে আপনি নারী বলে আপনাকে সারাজীবন গৃহবন্ধী হয়ে গৃহে কাজ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাই জেন্ডার ধারণা সামাজিক ভাবে নির্মিত নারী-পুরুষের ভিন্নতা বা স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করে।

সেক্স প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে সৃষ্ট একজন ব্যাক্তির বৈশিষ্ট্যসূচক ভিন্নতা প্রকাশ করে। সেক্স অপরিবর্তনশীল। যে ব্যাক্তি পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, জেন্ডারের ভিত্তিতে হয়তো তার একেক সমাজে একেক ভূমিকা হতে পারে কিন্তু সে পৃথিবীর যে জায়গায় থাকুক বা যে জায়গায় যাক তার পুরুষাঙ্গ, পুরুষাঙ্গই থাকবে। তাই সেক্স প্রাকৃতিক এবং জন্মগতভাবে নির্ধারিত হয়। সুতরাং সেক্স সার্বজনীন।

মোটকথা হচ্ছে, সেক্স অপরিবর্তনশীল, সার্বজনীন, শারীরিক বা জৈবিক এবং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। আর জেন্ডার পরিবর্তনশীল, সমাজ-সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন হতে পারে, নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত হয়।

সেক্স হলো নারীত্ব ও পুরুষত্বের জৈবিক উপাদান, আর জেন্ডার হলো নারী ও পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকবোধ। সেক্স হলো প্রাকৃতিক, শারীরিক, পূর্বনির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। আর জেন্ডার হলো সমাজ কর্তৃক আরোপিত, সমাজ সংস্কৃতিভিত্তিক, আচার-আচরণগত এবং পরিবর্তনীয়। সেক্স নারী ও পুরুষের শারীরিক পার্থক্য নির্দেশ করে। জেন্ডার সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট নারী-পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করে।

সেক্স হচ্ছে জন্মগত বা বায়োলজিক্যাল বিষয় যেখানে ছেলে এবং মেয়ের দৈহিক গঠন, শারীরবৃত্তীয়, জেনেটিক এবং হরমোনগত পার্থক্য রয়েছে। অপরদিকে জেন্ডার হচ্ছে সামাজিক বা মনস্ত্বাতিক পরিচয় যার সাথে বায়োলজির উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক নেই।

লিখেছেন রাজীব রায়হান

ট্রান্সজেন্ডার ও থার্ডজেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য কী?

ট্রান্সজেন্ডারবাদের কথা শুনলে বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, এটা হয়তো হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কোনও আন্দোলন। আসলে এটি মারাত্মক ভুল ধারণা। এই দুটি জিনিস একেবারেই আলাদা।

যাদের দেহ শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি, তারা পুরুষ আর যাদের দেহ ডিম্বাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি, তারা নারী। এটা শুধু বাহ্যিক যন্ত্রপাতির বিষয় নয়, পুরো প্রজননব্যবস্থার বিষয়। সুতরাং এখন যারা জন্মগতভাবে অস্বাভাবিক এবং কিছু যৌন ত্রুটি বা জটিলতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যাকে আমরা হিজড়া বলি, ইংরেজিতে তাদের বলা হয় ইন্টারসেক্স।

পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডাররা ইন্টারসেক্স নয়, তারা সম্পূর্ণরূপে পুরুষ বা নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে এবং পরে লিঙ্গ পরিবর্তন করে। মূলত বর্তমানে যারা নিজেদের ট্রান্সজেন্ডার দাবি করছে তাদের বেশির ভাগই ইন্টারসেক্স নয়। তাদের জন্ম হয়েছে সুস্থ ও স্বাভাবিক যৌনাঙ্গ নিয়ে।

রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিরা হলেন সেসব ব্যক্তি যাদের মানসিক লিঙ্গবোধ জন্মগত লিঙ্গ চিহ্ন হতে ভিন্ন। রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিরা যদি তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে ডাক্তারি সাহায্য কামনা করে তবে তাদেরকে অনেকসময় রূপান্তরকামী নামে ডাকা হয়।

তৃতীয় লিঙ্গ বা তৃতীয় যৌনতা হল একটি মতবাদ যাতে এমন ব্যক্তিদের শ্রেণীভুক্ত করা হয়, যারা হয় নিজে অথবা সমাজের দ্বারা পুরুষ বা নারী হিসেবে স্বীকৃত নয়। পাশাপাশি সমাজের একটি সামাজিক শ্রেণীকে বোঝায়। তৃতীয় লিঙ্গ" শব্দটিও ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হিজড়া হিসাবে বর্ণনা করা হয় যারা আইনি পরিচয় অর্জন করেছে ।

অতএব বলা যায়, ট্রান্সজেন্ডার হল যারা জন্মগত ভাবে ছেলে বা মেয়ে থাকেন কিন্তু পরবর্তীতে সার্জারী কিংবা বিভিন্ন অপারেশন এর মাধ্যমে নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তন করে থাকেন। কারণ তাদের মানসিক লিঙ্গবোধ শারীরিক লিঙ্গবোধ হতে ভিন্ন থাকে। 

এলজিবিটি (যেখানে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত) আন্দোলন মূলধারায় এসেছিল ১৯৫৫ সালে যখন সেক্স শব্দটির প্রতিভাষা হিসেবে জেন্ডার শব্দ প্রবর্তনের মাধ্যমে। এরপর থেকে সমকামিতা ইস্যুতে অনেক শব্দ যুক্ত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত শব্দগত বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শুরুতে এটা পরিচিত ছিল গে এবং লেসবিয়ান ইস্যু।

জেন্ডার আইডেন্টিটি হচ্ছে একধরনের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস বা অনুভূতি বা মানসিক অবস্থা। এটি যদি জন্মগত লৈংগিক পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্য হয় তবে তাকে সিসজেন্ডার বলা হয়। যদি এই মানসিক অনুভূতি জন্মগত লিঙ্গের সাথে অমিল হয় তবে তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলা হয়।

একসময় ট্রান্সজেন্ডার বলতে যারা হরমোন এবং সার্জারির আশ্রয় নিতো তাদেরকে শুধু এই শব্দ দ্বারা বুঝানো হতো। এটি এলজিবিটি এবং নন-বাইনারি নামক শব্দের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।

কার্যত এই শব্দগুলো সমকামিতা বা হোমোসেক্সুয়ালিটির সাথে জড়িত। যে প্রক্রিয়ায় কোনো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি (ট্রান্স ম্যান বা ট্রান্স উইমেন) বাহ্যিকভাবে নিজের আইডেন্টিটি প্রকাশ করতে পারে তাকে ট্রান্সজিশন বলা হয়। হিজড়া একটি জন্মগত জেনেটিক সমস্যা বা ডিসঅর্ডার।

আমেরিকার গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টও এই বিষয়টা আলোকপাত করেছে। তারা বলছে, হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার এক নয়। অন্যদিকে এলজিবিটি বা ট্রান্সজেন্ডারকে কোন অসুস্থতা, ডিসওয়ার্ডার বা কোনো মানসিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয় না। ট্রান্সজেন্ডার এর বাংলা অভিধানিক শব্দ হিজড়া লেখা হচ্ছে, আবার রূপান্তরকামীও বলা হচ্ছে যা মিসলিডিং।

ট্রান্সজেন্ডার অর্থ রূপান্তরিত লিঙ্গ। অর্থাৎ শারীরিক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এক লিঙ্গ হতে আরেক লিঙ্গে রূপান্তর হওয়া। সঙ্গে মানসিকভাবেও নিজেকে অন্য লিঙ্গের মানুষ হিসেবে মনে করা। নারী হয়েও নিজেকে পুরুষ মনে করতে পারেন। আবার পুরুষ হয়েও নিজেকে নারী মনে করতে পারেন। অতঃপর মানসিকতা শারীরিকভাবে বিকশিত করতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিবর্তন করে ট্রান্সজেন্ডারে পরিণত হন।

ট্রান্সজেন্ডার হচ্ছে– এক লিঙ্গের মানুষ হয়ে বিপরীত লিঙ্গের মানুষ বলে বা ভেবে নিজেকে প্রভাবিত করা। মূলত অনেকের রয়েছেন, যারা ছেলের শরীর নিয়ে জন্মে কিন্তু মনে মনে নারীর সত্তায় অবস্থান করেন। অতঃপর জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে তারা তাদের সেই শরীরটাকে নারীর দিকে নিয়ে যান।

ঠিক একইভাবে এমন অনেক নারী রয়েছেন, যারা নারীর শরীর নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন অথচ পুরুষের সত্তায় বেঁচে থাকেন এবং নিজের আচার-আচরণ, কাজকর্ম সব কিছুর মধ্য দিয়ে নিজেকে পুরুষ বলে দাবি করেন। আর এই বিষয়টাই ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে পরিচিত।

ট্রান্সজেন্ডার একটি পশ্চিমা আমব্রেলা টার্ম, যার বাংলা রূপান্তরিত জনগোষ্ঠী। সহজ করে বললে আপনি যদি আপনার জন্মগত বৈশিষ্ট্য বা আইডেন্টিটির বিপরীতে অন্য কোনো ধরনের আইডেন্টিটিকে ধারণ করতে চান তবে আপনি ট্রান্স আইডেন্টিটির মধ্যে নিজেকে শনাক্ত করতে পারেন। ট্রান্সজেন্ডার-এর মধ্যে দুটি ভাগ আছে। ট্রান্স ম্যান ও ট্রান্স ওমেন।

ইরানে রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীর লিঙ্গ পরিবর্তনের বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রীয় খরচে তা বহন করা হয়। রূপান্তরকামী আন্দোলনকর্মী রাচেল ক্র্যান্ডেল এর উদ্যোগে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে।

 

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top