মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

মানুষ উদ্বুদ্ধ হলে প্রতিরোধের সংগ্রামী বাহিনী তৈরি সময়ের ব্যাপার

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:৫৩

ছবি: সংগৃহীত

যে দেশে এক সময় কেউ বলে উঠেছিল সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না, সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ সেই দেশই এখন গর্জে ওঠে ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত, আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম, ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি রাজপথের মতো সব সংগ্রামী স্লোগানের হাত ধরে।

সময়ের প্রয়োজনে, নানারকম চাহিদায় মানুষের শ্লোগানের ভাষা পরিবর্তিত হয়। এক একটি শ্লোগানের সাথে মানুষের আবেগ-ভালোবাসা-ক্ষোভ-প্রতিবাদ অনেক কিছুই প্রকাশিত হয়। রক্তিম গণ-আন্দোলনে বজ্রগর্ভ মিছিলে আসমানের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত এদেশে নতুন নয়৷ মানুষ উদ্বুদ্ধ হলে প্রতিরোধের সংগ্রামী বাহিনী তৈরি সময়ের ব্যাপার৷

স্লোগানকে বলা হয় আন্দোলনের ভাষা। দাবির প্রয়োজনে মিছিল ও সমাবেশ থেকে স্লোগান জন্ম নেয়। হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতীক। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান বদলেও যায়। নতুন আন্দোলন তৈরি করে নতুন স্লোগান, যুক্ত হয় পুরোনোর রেশ।

আন্দোলন স্টম্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ার পেছনে স্লোগানের ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ। স্লোগান সব সময়েই নতুন নতুন স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষায় মানুষকে উজ্জীবিত করেছে, আন্দোলনে শামিল করেছে। স্লোগান আন্দোলনকারীদের ধমনিতে অন্যরকম শক্তি সঞ্চার করেছে।

শ্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষজন। শ্লোগান দিতে গিয়ে আমি বুঝতে শিখি কে ভাই কে দুশমন..শ্লোগান...শ্লোগান...শ্লোগান... । প্রতুলের একটি গানই বলে শ্লোগানের কত শক্তি ক্ষমতা।

১৯৫৩ সালে শ্লোগান উঠেছিল শহীদ স্মৃতি অমর হউক। ১৯৫৬: মৃত্যুমুখী মানুষকে বাঁচাও।১৯৬২: শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিহার কর। পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা চলবে না। স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট জিন্দাবাদ। ভাসানীর দাবী দেশের দাবী। ভাসানীর দাবী মানতে হবে। রাজনৈতিক দল আইন বাতিল কর।

১৯৬৬: সোনার দেশ আজ শ্মশান কেন! গণসংগ্রামেই বাজবে গণমুক্তি। সহজলভ্য শিক্ষা চাই। ১৯৬৭: ১১ দফার বাস্তবায়ন চাই। নারী শিক্ষার প্রসার চাই। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ চলবে না। কমিউনিস্ট পার্টির উপড় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার কর। ১৯৬৮: গণতন্ত্র কায়েম কর।

১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে জ্বালো জ্বালো- আগুন জ্বালো স্লোগান শোনা যেত। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের স্লোগান ছিল জেগেছেরে জেগেছে-বীর বাঙালি জেগেছে; বীর বাঙালি জেগেছে- রক্তসূর্য উঠেছে।

অপরদিকে বামপন্থীদের স্লোগান ছিল মুক্তির এই পথ- সশস্ত্র বিপ্লব; কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর- জনগণতন্ত্র কায়েম কর। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভা–সমাবেশে তাঁর কর্মীরা স্লোগান ধরতেন, ভোটের আগে ভাত চাই- নইলে এবার রক্ষা নাই। 

লেখক–সাংবাদিক আবু সাঈদ খান তাঁর স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি বইয়ে লিখেছেন, ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানে আরেকটি স্লোগান হলো তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা। জেলের তালা ভাঙব- শেখ মুজিবকে আনব।

পূর্ব পাকিস্তান যখন গণ–অভ্যুত্থানে উত্তাল তখন জামায়াতে ইসলামি বাঙালির দাবির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সিদ্দিকুর রহমান স্বপন তাঁর বইয়ে বলেছেন, পাকিস্তানের শত্রুরা হুঁশিয়ার সাবধান- স্লোগান দিতেন দলটির নেতা–কর্মীরা। এমনকি মাওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে সর্দি কাশি হাপানি- মাওলানা ভাসানী; চিড়িয়াখানার আজব প্রাণী- মাওলানা ভাসানী—এমন স্লোগানও শোনা যেত।

আবু সাঈদ খান লিখেছেন, গণ–আন্দোলনের একপর্যায়ে ওই দিন ঢাকায় ছাত্রলীগের কর্মীসভায় সংগঠনের কর্মীদের একাংশ প্রথম জয় বাংলা স্লোগান দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমদ প্রথম জয় বাংলা স্লোগান ধরেন। পরবর্তী সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই স্লোগান অনুপ্রেরণার বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছিল।

মহান একাত্তরে বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো । জাগো জাগো- বাঙালি জাগো। দুনিয়ার মজদুর- এক হও। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো- বাংলাদেশ মুক্ত করো। ছাত্র-শিক্ষক-জনতা- গড়ে তোল একতা। শহীদের রক্ত- বৃথা যেতে দিবো না। রক্তের বন্যায়- মুছে যাবে অন্যায়। পাকিস্তানের দালালেরা- হুশিয়ার সাবধান।

১৯৯০: এরশাদ পতনের আন্দোলনে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল জনতার দাবি এক- এরশাদের পদত্যাগ; এক দফা এক দাবি- এরশাদ তুই কবে যাবি। আর এরশাদের পতনের পরপর স্লোগান উঠেছিল এই মাত্র খবর এলো- এরশাদ পালিয়ে গেল।

আবু সাঈদ খান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের নাম (সেলিম, তাজুল, দীপা, বসুনিয়া, কাঞ্চন, ময়েজউদ্দিন প্রমুখ) বারবার স্লোগানে উঠে এসেছে। স্লোগান উঠতো শহীদদের রক্ত- বৃথা যেতে দেবোনা; বিপ্লবের লাল ফুল- কমরেড তাজুল; দীপা–কাঞ্চন ডাক পাঠাল, সব সাথীদের খবর দে- বেঈমানি যাঁর শিরায় শিরায়, সেই দালালদের কবর দে। এরশাদবিরোধী গণ–আন্দোলনে একটি স্লোগান আলোড়ন তুলেছিল—গণতন্ত্র মুক্তি পাক-স্বৈরাচার নিপাত যাক।

২০২৪: হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে শ্লোগানে উত্তাল হয় রাজপথ। আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার- কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার। স্লোগান ওঠে, লাখো শহীদের রক্তে কেনা-দেশটা কারো বাপের না।

২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার আন্দোলনে চাইলাম অধিকার- হয়ে গেলাম রাজাকার; আপস না সংগ্রাম- সংগ্রাম সংগ্রাম; দালালি না রাজপথ- রাজপথ রাজপথ; আমার সোনার বাংলায়- বৈষম্যের ঠাঁই নাই; একাত্তরের হাতিয়ার- গর্জে ওঠো আরেকবার; যে হাত গুলি করে- সে হাত ভেঙে দাও; অ্যাকশন অ্যাকশন- ডাইরেক্ট অ্যাকশন; গুলি করে আন্দোলন- বন্ধ করা যাবে না; জাস্টিস জাস্টিস- উই ওয়ান্ট জাস্টিস; জ্বালোরে জ্বালো- আগুন জ্বালো; দিয়েছি তো রক্ত- আরও দেব রক্ত- রক্তের বন্যায় – ভেসে যাবে অন্যায়—এমন স্লোগান শোনা যায়।

মিছিলে–সমাবেশে লাশের ভেতর জীবন দে- নইলে গদি ছাইড়া দে; ছি ছি হাসিনা- লজ্জায় বাঁচি না স্লোগান দেওয়া হয়। দুটি স্লোগান যেন আদতেই বারুদ হয়ে আন্দোলনকারীদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল—বুকের ভেতর কঠিন ঝড়- বুক পেতেছি গুলি কর এবং লেগেছে লেগেছে- রক্তে আগুন লেগেছে।

প্ল্যাকার্ড ও দেয়াললিখনে কিছু স্লোগান দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন অনাস্থা অনাস্থা- স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা; উই ওয়ান্ট জাস্টিস; চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন- এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ; হাল ছেড় না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে।

কিছু পুরানো স্লোগান এবারও উচ্চারিত হয়েছে। যেমন ভুয়া ভুয়া; জ্বালো রে জ্বালো- আগুন জ্বালো; স্বৈরাচারের দালারেরা- হুঁশিয়ার সাবধান। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের সাড়া জাগানো ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটিও নতুন প্রাণ পেয়েছে। যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ। এমন হাজারো শ্লোগান জন্ম হয়েছে অগ্নিমিছিলে। শ্লোগানে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। আঁতকে ওঠে শাসকের আত্মা। জয় হয় জনতার। এটাই বোধ হয় গণতন্ত্রের শেষ কথা। মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে জয় করার পাঠ শুরু হয় মিছিল থেকেই।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top