জ্বলন্ত দেহের আর্তনাদ কী পৌঁছায় আনন্দোল্লাসে মত্ত থাকা সভ্য সমাজে?

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:১৯

ছবি: সংগৃহীত

উৎসবপ্রিয় বাঙালির উদযাপনের অন্ত নেই। থার্টি ফার্স্ট নাইট তার একটি। আনন্দ-আয়োজনে থাকে আতশবাজি, পটকা, ফানুস। উচ্চশব্দে মিউজিক বাজিয়ে নতুন বছরকে আগমন জানানোর ভীষণ প্রবণতা। মুহুর্তটি দেখতে সুন্দর হলেও ক্ষত ভয়ঙ্কর।

আসলে আতশবাজি স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। গবেষণা বলছে,  এতে ব্যবহার করা হয় কার্বন ও সালফার। এই দুটি মৌল পুড়ে তৈরি হয় কার্বন মনো–অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড। কার্বন মনো–অক্সাইড গ্যাস বাতাসের মাধ্যমে আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তে মিশে যায়। ফলে শরীরের রক্ত পরিবহনে সমস্যা দেখা দেয়।

পাশাপাশি ফুসফুসের ক্যানসারের জন্যও দায়ী এই গ্যাস। কার্বন মনো–অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড মিলে তৈরি করে রেডিক্যাল। ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার জন্য এই রেডিক্যালই দায়ী। কার্বন ডাই-অক্সাইডের ক্ষতিকর প্রভাব কমবেশি সবাই জানি।

এর ফলে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এতে রক্তের চাপ বেড়ে যায় মস্তিষ্কে। ফলে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এই দুই মৌলের পাশাপাশি আতশবাজিতে আরও ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম নাইট্রেট, অ্যালুমিনিয়াম ও বেরিয়াম নাইট্রেট। পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের জন্যও এগুলো ক্ষতিকর।

বিশেষ করে ফানুস উড়ানো থেকে সহজেই অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। আতশবাজির ধোঁয়া শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে। আতশবাজির তীব্র শব্দ ও উজ্জ্বল আলোর কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়। শত শত পাখি বাসা থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। শব্দের এই বিভীষিকায় অসহায় হয়ে পড়ে পাখিরা।

অসহায় হয়ে ছুটে চলে দিগ্বিদিক। জ্ঞানশূন্য হয়ে চলতে গিয়ে দালানকোঠা ও গাছপালায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বিদ্যুতের তারে ধাক্কা খেয়ে মারা যায়। পাখির যোগাযোগের মাধ্যম শব্দ। অতিরিক্ত শব্দের কারণে পাখি চলাচলের রাস্তা ভুলে যায়। পরে আর ফিরতে পারে না। উঁচু দেওয়ালের সঙ্গে আঘাত খেয়েও অনেক পাখি মারা যায়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে আতশবাজির ভয়াবহতায় বলা হয়েছে, আতশবাজির কণাগুলো ধাতব লবণের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শুধু যে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তা নয়। এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে চিহ্নিত কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেনযুক্ত গ্যাস তৈরি হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলোর অন্যতম।

ফ্রন্টিয়ারস ইন ইকোলজি অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আতশবাজির বিকট শব্দ ও উজ্জ্বল আলোর কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়। বছরের অন্য রাতের তুলনায় থার্টিফার্স্ট নাইট রাতে পাখিদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে থাকে বেশি।

নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের রাডার এবং পাখির সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা চালিয়েছেন। তারা আতশবাজি ফোটানো এলাকাগুলোর সঙ্গে নীরব বা শান্ত এলাকায় পাখিগুলোর গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন। এতে তারা দেখতে পান, আতশবাজির শব্দ পাখিদের ওপর এক ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে। যা কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আতশবাজির মুহুর্মুহু শব্দে পাখিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে।

উৎসবগুলোর এমন আনন্দ যেন অন্য প্রাণীর ভয়, আতঙ্ক ও মৃত্যুর কারণ যেন না হয়। পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আতশবাজির শব্দের কারণে পাখিদের মধ্যে বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। ফলে খাবারের সন্ধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয় পাখিদের। বিঘ্নিত হয় পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন। পাখি নগরে যুদ্ধাবস্থা মনে করে অন্যত্র চলে যায়। তারা আর ফিরতে নাও পারে! পাখিরা না ফিরলে প্রাণপ্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। ফুল ও ফলে পরাগায়ণ হবে না। উৎপাদন কমে যাবে।

পাখির বসবাস উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব সকলের। পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করার স্বার্থে সবাইকে বিধিনিষেধ মানতে হবে। পাখির সুরক্ষার প্রতি সকলকে দায়িত্বশীল ও যত্নবান হওয়ার কথা বলছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের অভিজ্ঞতা থেকে এক পাখিপ্রেমী লিখেছেন: ওই রাতে আতশবাজি ফুটাচ্ছে দেখে বাসার ছাদে উঠেছিলাম অন্য অনেকের মতোই। ক্যামেরাও সাথে নিয়ে উঠেছিলাম থার্টি-ফার্স্ট নাইটের আতশবাজি ফোটানোর কিছু ছবি তোলার ইচ্ছা নিয়ে। হঠাৎ দেখি বড় কী যেন ছটফট করতে করতে ছাদে এসে পড়ল, খেয়াল করে দেখে বুঝতে পারলাম একটা চিল, একেকবার একেক দিকে আতশবাজি ফোটানোর শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পালাচ্ছে।

তিনি আরও লিখলেন, এরপরে আতশবাজির দিকে না তাকিয়ে রাতের আকাশের দিকেই তাকিয়েছিলাম পুরোটা সময়। নিজের চোখে দেখলাম আলোর ঝলকানি আর শব্দ শুনে সবার উল্লাসের মাঝেই অসংখ্য পাখি এদিক সেদিক উড়ে পালাচ্ছে, যেইদিকেই তারা উড়ে যায় সেইদিকেই আতশবাজি ফোটে, সাথে সাথে তারা উল্টো দিকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে সবদিকেই, তারা পালাবে কোথায়! এত পাখি দেখে মনে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর রমনা উদ্যানের যত পাখির বাসা সব পাখিই নিজেদের বাসা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে শব্দ আলোর কারণে।

রাতের অন্ধকারে দূর দিয়ে উড়লে বোঝা যাচ্ছে না, কাছাকাছি যেসব পাখি উড়ছে সেগুলোকে চেনা যাচ্ছে। কবুতর, প্যাঁচা, কাক, চিল, শালিক কোনো পাখিই বাদ নাই। ঢাকায় গাছগাছালি কম হওয়াতে অনেক পাখিই থাকে ঢাকার এই দিকটায়, রমনা আর ঢাবির দিকে।

আতশবাজির শব্দের চোটে একটা পাখিও সম্ভবত বাসায় থাকতে পারে না ওই রাতে।...সেই দিনের পর থেকেই আমি থার্টিফার্স্ট নাইটের পরের দিন রাস্তায় বের হলে খেয়াল করি, কতগুলো পাখি মরে পড়ে আছে। সকাল বেলায় ঝাড়ুদাররা বেশির ভাগ মরা পাখিই সরিয়ে নিয়ে যান রাস্তা থেকে, কিন্তু এরপরেও খেয়াল করলে দেখবেন, একেক জায়গায় কতগুলো পাখি মরে পড়ে আছে।’

আনন্দের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করা নয়, বরং যত্ন করা জরুরি। থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন জীবনে আনন্দ বয়ে আনে ঠিকই, তবে তা যেন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ না হয়, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া আমাদের দায়িত্ব।

আনন্দকে স্বাধীনভাবে উপভোগ করা যেমন মানুষের অধিকার, তেমনি একই আনন্দকে উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকাও পাখপাখালি-গাছপালার সমান অধিকার। যতই বলি, জ্বলন্ত দেহের আর্তনাদ কী পৌঁছায় আনন্দোল্লাসে মত্ত থাকা সভ্য সমাজে?

মৌসুমী ভৌমিকের গান দিয়ে শেষ করি।
ছোট পাখি ছোট পাখি
সর্বনাশ হয়ে গ্যাছে
পৃথিবীর প’রে আর
তোমার আমার
ভালোবাসার কেউ নেই কিছু নেই।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top