দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে একমাত্র লাল দিয়েই পরিবর্তন সম্ভব

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ৭ জানুয়ারী ২০২৫, ২১:২৯

ছবি: সংগৃহীত

ব্যর্থ সমাজের প্রকৃতি সম্পর্কে আন্তন চেখভ বলেন, ব্যর্থ সমাজে মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে জেগে ওঠে না। সে জেগে ওঠে শ্লোগানে। চিন্তাশীল মানুষের মূল্য বা ওজন কেউ বুঝে না। অধিকাংশ মানুষ আজেবাজে কথায় সময় পার করে দেয়। আজে বাজে কথা বলে যে মানুষকে হাসায়, তার চেয়ে কঠিন সত্য বলে যে বাস্তবতাকে জাগিয়ে তোলে তাকে কেউ গ্রহণ করে না। অজ্ঞ সংখ্যাগরিষ্ঠরা এখানে আপনার ভাগ্য নির্ধারণ করে। ব্যর্থ সমাজে মানুষ ব্যর্থ হয় না, এখানে সচতুরভাবে তাকে ব্যর্থ বানানো হয়।

স্বপ্নভঙ্গের মরণাপন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক চিন্তকেরা নানা চিত্র আঁকেন।রাষ্ট্রযন্ত্রের ত্রাসে তটস্থ থাকেন রাজপথে থাকা সাধারণ কর্মীরা। বিপ্লবী কিংবা বুর্জোয়া সংগঠন যাই বলেন না কেন। প্রতিটি সংগঠনের প্রাণ ভোমরা মেহনতী কর্মীরা। তাদেরই প্রচেষ্টায় সংগঠন বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। যদি কর্মীদের খোঁজখবর, মূল্যায়ন না করা হয়। কর্মীদের অপদার্থ বস্তুর মতো নিষ্ক্রীয় করে রাখা হয়। তাদের মতামত গুরুত্বের সাথে নেওয়া না হয়। সামনে এগোনোর উদ্দীপনা দেওয়া না হয়। তাহলে কী ঘটে বলুনতো। কর্মীরা নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করে গুটিয়ে নেয়। যথেষ্ট ক্রিয়াশীল সক্রিয় কর্মীরা একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ফলে সংগঠন তার জৌলস হারিয়ে ফেলে।

একসময় বাম সংগঠন ছিল তেজস্বী, রমরমা। বামপন্থি রাজনীতির ছিল সমৃদ্ধ ইতিহাস। দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বামপন্থিরাই ছিলেন নেতৃত্বে। তাদের পরিকল্পনাতেই দেশের বেশিরভাগ গণআন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। তাদের স্লোগানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণের অংশগ্রহণ ছিল উদাহরণ। কোনও গণআন্দোলনই বামপন্থিদের বাদ দিয়ে সম্ভবপর হয়নি এদেশে।

তবে সময়ের ব্যবধানে সেই সমৃদ্ধ ইতিহাস ফিকে হয়ে গেছে। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার চেষ্টা করছে বামসংগঠনগুলো। তাদের সেই সোনালি অধ্যায়, জৌলুস দাপটের অকালমৃত্যু ঘটতে চলেছে। আগের মতো বামপন্থিদের সেই পুরোনো গৌরব তেমনটা নেই বললেই চলে। এখন শুধুই পত্রিকায় টিকে থাকা ইতিহাস মাত্র।

তাদের চিন্তার পরিসর এখন ভীষণ সংকীর্ণ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিকতা ভর করেছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে। নানা টানাপোড়েনে আদর্শিক গতিপথ টালমাটাল অবস্থা। বিনষ্ট রাজনীতি ও বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে তারাও হাবুডুবু খাচ্ছেন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থ- চিন্তায়, মননে, হিসাবে অঙ্ক মেলে না। নেতাকেন্দ্রিক নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টা অব্যাহত বিপ্লবীদের মগজে। রাজনৈতিক দর্শন চর্চা আগের মতো তেমন একটা নেই। মনে রাখবেন, এসব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ বলে পালানোর রাস্তাটা খোলা নেই। ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ, ক্রোধে কুলক্ষয়।

এভাবে বিপ্লব ঘটে না বন্ধু বরং বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাটাও অপরাধ মনে হয়। একটি সংগঠন যখন কর্মী চিনতে পারে না। কর্মীকে যোগ্য করে গড়ে তোলবার বদলে বিচ্ছিন্ন করে রাখে ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। তখন সেই সংগঠনের কর্মী পালবার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কোন্ কর্মীর বুকের ভেতর আগুন জ্বলে। কাকে দিয়ে বিপ্লবের মশাল জালানো যায়। কাকে দিয়ে কোন্ জায়গায় খেলাবেন সেটা নির্ধারণ করবার মুন্সিয়ানা থাকতে হয়। কার মধ্যে রাজনীতি বোঝাপড়ার যোগ্যতা কতটুকু। কে রাজনীতি কতটুকু ধারণ করেন। রাজনীতিটাকে কে কতটুকু বোঝেন। সেটা পরখ করতে হয় নেতৃত্বকে।

যে বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে বামে এসেছিলাম, সেটা মরেনি। সেই আকাঙ্খার লড়াই জারি থাকবে। কিন্তু এমন সংগঠনে থাকতে চাই না। যেখানে কেবল জীবনের সাথে মশকরা চলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন ও সাংবাদিকতার ক্ষুদে ছাত্র হিসেবে এটা আমার মূল্যায়ন। এসব কেবল কথার কথা নয়। কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগপত্রও নয়। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ।

লালের প্রতিটি সদস্যকে নিয়ে আমার পরিবার। অভিযোগ খেলা তো অনেক হয়েছে, আর করতে চাই না। জায়গা জমি, টাকা পয়সার ভাগবাটোয়ারার কোনও ব্যাপার নেই পার্টিতে। আছে কেবল বিপ্লবের বুকভরা আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খায় পথের কাঁটা চিনতে হয়। তুলে ফেলে সামনে এগুতে হয় জোর কদমে। দূরের তারাটি চিনতে হয় রাজনীতিতে। দূরদৃষ্টি থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। নিজের ভুলত্রুটি চিনে নিয়ে শোধরাতে হয়।

সংগঠনের মধ্যে জবাবদিহির জায়গা থাকতে হবে। দ্বন্দ্ব ও দ্বিমত থাকতেই পারে। ভিন্নমতে একমত না হলেও শ্রদ্ধা জরুরি।। সংগঠন কেবল নেতাদের দিয়ে গঠিত হয় না মনে রাখবেন। নেতৃত্বের মূল চালিকাশক্তি স্নেহ, হৃদ্যতা। তাচ্ছিল্য বা তামাশা সংগঠন মজবুত করে না। বিপ্লবের ভাবগাম্ভীর্য অনুধাবন করে লড়াইটা জারি রাখেন কমরেড। সংকট উত্তরণে মূল্যবোধগুলোকে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দিতে হবে। তাত্ত্বিকতা যেমন জরুরি, সমান জরুরি মাঠে থাকা। রাজনীতির ময়দানে এভাবেই শত্রু মিত্র চিনতে হয়। এভাবেই সংগঠন অভিভাবকের জায়গা নেয়। এটাই আমার ভাবীকথন। ক্ষমা করবেন কমরেড সহযোদ্ধা। 

যুগপৎ, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ও ঐক্য প্রক্রিয়ার নামে দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে দাঁড়ান কিভাবে প্রশ্ন জাগে। গণতন্ত্রের মিত্রশক্তি আর গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল জোট কখনো এক হতে পারে না। লাল ঝাণ্ডাধারী বন্ধুগণ দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙার আওয়াজটা জোরদার করুন। নিজস্ব অবস্থান তৈরি না হলে সাধারণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেনতো। তখন শহীদের সঙ্গে বেঈমানীর আমলনামা অনেক বড় হয়ে যাবে।

কর্মী মূল্যায়ন করেন, সাবেকদের সঙ্গে যোগাযোগ মাত্রাটা বাড়ান। পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে শহীদের নামে আরেকবার শপথ নেন শক্ত করে। এক শত্রু বিতাড়িত করে আরেক শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব পরিহার করেন। লালে লাল মিশিয়ে সাম্যের পৃথিবী গড়তে নতুন উদ্যমে পা রাখেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে একমাত্র লাল দিয়েই পরিবর্তন সম্ভব। শুধু একজন নেতা দরকার যিনি গণমুক্তিতে নিজেকে বলি দেওয়ার সাহস রাখেন। বলতে পারেন, ভয় নেই বন্ধু মুক্তির পথ লাল। মুক্তির প্রশ্নে লাল কারও সাথে আপোস করে না।

কবি দিনেশ দাশের কবিতা দিয়ে শেষ করি-

বেয়নেট হোক যত ধারালো—
কাস্তেটা ধার দিয়ো, বন্ধু!
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিয়ো, বন্ধু।

দিগন্তে মৃত্তিকা ঘনায়ে
আসে ওই! চেয়ে দ্যাখো বন্ধু!
কাস্তেটা রেখেছো কি শানায়ে
এ মাটির কাস্তেটা, বন্ধু!




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top