আমার মোনাজাতে মোনাজাত ভাই
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:২৩
নিউজরুমটা তখন নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতোই চুপচাপ। যার যার ডেস্কে বসে নিরবে কাজ করছেন কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক। ভরদুপুরের মিটিং শেষে দল বেঁধে সব রিপোর্টার লাঞ্চে গেছে পাশের রেস্তোঁরায়। হাতের কাজটা শেষ করে আমিও বেরিয়ে পড়বো। যোগ দেবো তাদের সাথে।
নিউজপ্রিন্টের প্যাডে খস্ খস্ করে লিখে চলেছি। খুব দ্রুত ছুটছে বলপেন। হাতে একদম সময় নেই। বার বার তাড়া দিচ্ছেন কেজি ভাই। আমার রিপোর্টটায় চোখ বুলিয়ে তিনিও বের হবেন।
নিউজরুমে ঢুকলেন দীর্ঘদেহী একজন মানুষ। পরনে পাঞ্জাবি-পাজামা। কাঁধে ঝোলা। তাঁকে দেখেই সরগরম হয়ে উঠলো নিস্তরঙ্গ নিউজরুম। সবাই তাঁর খোঁজ-খবর নিতে ব্যস্ত-
কেমন আছো? এবার কি নিয়ে এলে?
এইমাত্র এলেন? এবার কোত্থেকে?
তিনি হাসি মুখে বিভিন্ন জনের এমনি সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। সবার সাথে কুশল বিনিময় করছেন।
আমি মুগ্ধ চোখে তাঁকে দেখছি। তাঁর কতো সব অসাধারণ রিপোর্ট পড়েছি। অপার মুগ্ধতায় পড়েছি তাঁর লেখা। এই প্রথমবার সামনাসামনি তাঁকে দেখছি। আমার চোখ নড়ছে না।
তিনি আমার পাশের খালি ডেস্কে বসতেই এগিয়ে এলেন ফকির ভাই, ভাত খাইছেন? চা এখন দিমু না পরে?
না ফকির ভাই, এখনো খাওয়া হয়নি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে।
তাইলে যান.. আগে ভাত খাইয়া আসেন..
কাঁধ থেকে নামিয়ে ঝোলাটা রাখলেন টেবিলে। আমার কাঁধে রাখলেন স্নেহের হাত, তোমার সাথে আগে দেখা হয়নি.. আমি মোনাজাতউদ্দিন..
সংবাদ-এর রিপোর্টার হয়েও মোনাজাতউদ্দিনকে চিনবো না, সে কি হয়!
সারা বাংলাদেশ তাঁকে চেনে। সম্মান করে। ভালোবাসে। মাঠপর্যায়ে এমন কঠোর পরিশ্রমী, ত্যাগী, একনিষ্ঠ এবং মেধাবী সাংবাদিক আর কে আছে!
কি অসাধারণ লেখেন মোনাজাত ভাই! পড়তে পড়তে কখন ফুরিয়ে যায় তাঁর দীর্ঘ লেখা, টেরই পাওয়া যায় না। পড়া শেষ হলেও রেশ থেকে যায়।
সেই মোনাজাতউদ্দিন আমার পাশের চেয়ারে বসে আছেন! আমার কাঁধে রেখেছেন তাঁর স্নেহের হাত! সেটা ভাবতেই পারছি না চব্বিশের আমি।
রিপোর্টিংয়ে নতুন জয়েন করেছি.. আমি হাসনাইন খুরশেদ..
ওহ! তোমাকে তো চিনি.. তোমার রিপোর্ট পড়েছি..
আমার বিস্ময় কাটে না!
হাতের রিপোর্টটা লেখা শেষ। হাতে পেয়ে চোখ বুলালেন কেজি ভাই। বায়ান্নের ভাষা সৈনিক, প্রথিতযশা সাংবাদিক কেজি মোস্তফা।
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে কেজি ভাই পড়লেন পুরোটা রিপোর্টট। বার্তা সম্পাদক আতা ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললেন, সব ঠিকই আছে।
আমি ফিরে এলাম আমার ডেস্কে।
সকালের অ্যাসাইনমেন্ট কভার করে অফিসে ফিরেছি দুপুর দুইটায়। তখন আবার মিশু ভাইয়ের মিটিং। সেই মিটিং শেষে
অ্যাসাইনমেন্টের রিপোর্ট লিখতে বসা।
চারটা বাজতে চলেছে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
কবির হোটেলে খেয়েছো কখনো?
কোথায় এটা?
সংবাদ-এ রিপোর্টার.. গলাকাটা কবির চেনো না! মজা করে হাসলেন মোনাজাত ভাই, চলো আজকে এক সাথে কবিরে খাবো..
দল বেঁধে লাঞ্চে গেছেন চীফ রিপোর্টার কাশেম হুমায়ূন ভাই, জাফর ওয়াজেদ ভাই, রাজা ভাই, সাইফুল ভাইরা। আমারও তাদের সাথে যোগ দেয়ার কথা। দুপুরে প্রায়ই এক সাথে খাই আমরা সব রিপোর্টার।
মোনাজাত ভাইয়ের ডাকে সব ভুলে তাঁর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। নিচে নেমে বাইকের দিকে এগুতেই থামালেন তিনি, কাছেই.. চলো হেঁটে যাই..
সংবাদ-এর গলি পেরিয়ে মুল সড়কে উঠলাম। ওপারে রাস্তার পাশেই বেশ বড় একটা টিনের ঘর। সামনে ছোট্ট সাইনবোর্ড - কবির হোটেল।
প্রতিদিন এই রাস্তা ধরে অফিস-বাসা করি। অথচ কোনদিন চোখেই পড়েনি।
ম্যানেজার থেকে ওয়েটার- সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো মোনাজাত ভাইকে দেখে। টেবিল ঝেড়েমুছে আমাদের বসার ব্যবস্থা করলো। ভাত-ভর্তার সাথে নিয়ে এলো কবুতরের মাংস। ওরা জানে, এটা মোনাজাত ভাইয়ের প্রিয় খাবার। আমি এর সাথে নিলাম ইলিশের ডিম।
'৯২ সালের শেষ ভাগে মোনাজাত ভাইয়ের সাথে সেই প্রথম দেখা। কি বিশাল ব্যক্তিত্ব! কি বিপুল জনপ্রিয়তা! কি অসাধারণ ধীশক্তি! কি ক্ষুরধার কলম! কি গভীর অনুসন্ধিৎসু হৃদয়! অথচ কি অমায়িক এক মাটির মানুষ!
পরিচয়ের প্রথম দিনেই মোনাজাত ভাই আমাকে আপন করে নিলেন। কতো কিছু খাওয়ালেন। কতো গল্প করলেন। এক সময় বললেন, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চলো, এবার উঠি।
সংবাদ-এ আমার কর্মজীবন মাত্র এক বছরের। '৯২-এর আগস্টে যোগ দেই দৈনিক জনকণ্ঠে।
বরেণ্য সাংবাদিক তোয়াব খানের ডাকে সাড়া দিয়ে কয়েক মাস পর মোনাজাত ভাইও যোগ দেন জনকণ্ঠে।
সংবাদ-এর পল্টন অফিস থেকে যে হৃদ্যতার শুরু, জনকণ্ঠের মতিঝিল অফিসে তা আরো প্রগাঢ় হয়। মাঝে মাঝে ঢাকা আসতেন মোনাজাত ভাই। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। তাঁর কাছ থেকে কতো কিছু শেখার চেষ্টা করেছি।
মোনাজাত ভাই শেখাতেন বন্ধুুর মতো করে। বোঝাই যেতো না যে, তিনি শেখাচ্ছেন। তিনি পাশে থেকে, হাতে হাত রেখে সামনে এগিয়ে নিচ্ছেন।
সেই এগিয়ে নেয়ার কথাটা না বললে অকৃতজ্ঞতা হবে। যতো দূর এগুতে পেরেছি, তাতে মোনাজাত ভাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋণ।
সম্ভবতঃ '৯৩-এর এক দুপুরে নিউজরুমে বসে আছি, রংপুর থেকে এলো মোনাজাত ভাইয়ের ফোনকল। তিনি আমাকে খুঁজছেন।
শুচি, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে কিছু তথ্য বের করে দিতে পারবে? একটা রিপোর্টের জন্য খুব দরকার।
কথা হলো অনেকক্ষণ। সব শুনলাম। তিনি যে সব তথ্য-উপাত্ত চাইলেন, সেগুলো খুব গোপনীয় কিছু নয়। তিনি চাইলেন, গত পাঁচ বছরে নকল-ভেজাল ওষুধ কি পরিমাণ আটক হয়েছে, কতো মামলা হয়েছে, কতোজন আটক হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি..
মোনাজাত ভাই, আপনি চাইলেই তো ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য দেবে..
না, না, আমি পারবো না। তথ্যগুলো বের করে দিও প্লিজ। ঢাকায় কাউকে আমি চিনি না।
হেসে ফেললাম আমি, আপনার চেনার দরকার নেই.. আপনাকে তো সবাই চেনে..
না, না, তুমি এটা করে দাও.. আমি দুয়েক দিনের মধ্যে ঢাকা আসবো.. তখন লাগবেই..
আমি নিশ্চিত জানি, মোনাজাত ভাই ফোনে বললেই ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য দিয়ে দেবে। তিনি ঢাকা এসে হাতে পেয়ে যাবেন। তবু আমাকে জোর করছেন কেনো! বুঝে উঠতে পারছি না।
আমি পরদিনই সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রাখলাম।
তোয়াব ভাইয়ের সকাল এগারোটার মিটিং শেষে বেরিয়ে দেখলাম, নিউজরুমে মোনাজাত ভাই। কাগজগুলো তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অ্যাসাইনমেন্টে।
সন্ধ্যায় ফিরে দেখলাম, মোনাজাত ভাই অফিসে নেই। শুনলাম, রাতটা ঢাকায় কাটিয়ে পরদিনই তিনি আবার বেরিয়ে পড়বেন। দেশের কোন না কোন প্রান্তে ছুটবেন খবরের খোঁজে।
জনকণ্ঠ তখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক। একযোগে ছাপা হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও বগুড়া থেকে। সবার আগে পৌঁছে যায় সব পাঠকের হাতে।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে জনকণ্ঠ হাতে নিয়েই চমকে উঠলাম। প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে আট কলাম ব্যানার শিরোনাম- সীমান্তের গ্রামে গ্রামে নকল-ভেজাল ওষুধের কারখানা।
অসাধারণ সেই অনুসন্ধানী রিপোর্টের ক্রেডিট-লাইনে লেখা- মোনাজাতউদ্দিন ও হাসনাইন খুরশেদ।
সারা দিন যতো জায়গায় গেলাম, যতো জনের সাথে দেখা হলো, শুনলাম একই কথা- 'মোনাজাতউদ্দিনের সাথে আপনার
যৌথ রিপোর্ট দেখলাম..'
অনেক পরে বুঝেছি, খুব ভালোবাসেন বলেই সাধারণ কিছু তথ্য আমাকে দিয়ে সংগ্রহ করিয়ে ছিলেন। তাঁর নামের সাথে আমার নামটিও জুড়ে দিয়েছিলেন।
মোনাজাত ভাইকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রিপোর্টটা তো আপনার ছিলো। আমার নাম কেনো জুড়ে দিলেন?
তিনি হাসলেন স্নেহের হাসি। কিছু বললেন না। আমি বার বার জানতে চাইলাম। এক সময় বললেন, এই রিপোর্টের কিছু তথ্য তো তুমি জোগাড় করেছো।
সেটা তো আপনি নিজেও করতে পারতেন! সীমান্তের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন আপনি.. সব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন আপনি.. আমি তো এর কিছুই জানি না..
দেখো, তুমি এখনো অনেক ছোট। এই বয়সেই ভালো ভালো রিপোর্ট করছো। আমি চাই, আমার যারা পাঠক, তারা তোমাকেও চিনুক। তোমার রিপোর্ট পড়ুক।
বরেণ্য মানুষ মোনাজাতউদ্দিন ভাই এভাবেই খুব নিরবে, খুব নিভৃতে আমার মতো অনেকের জীবন গড়তে পাশে থেকেছেন।
আজ মোনাজাত ভাইয়ের ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী। পরম করুণাময় আল্লাহ্তায়ালার কাছে আমার মোনাজাত, হে আল্লাহ, মোনাজাত ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিন।
(সিনিয়র জার্নালিস্ট হাসনাইন খোরশেদের ফেসবুক পাতা থেকে)
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।