ফিরে দেখা ২০২৪: অস্থির বিশ্বে স্বস্তির অভাব
রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:২৬
স্বস্তির আশা নিয়ে শুরু হলেও ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বজুড়ে বেড়েছে অস্থিরতা। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-উত্তেজনা কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোনোটারই সমাধান হয়নি। এর সঙ্গে বরং যোগ হয়েছে ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা। অস্থিরতা বেড়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। আসুন, চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি আলোচিত ঘটনার ওপর।
গাজা যুদ্ধ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ইসরায়েল অভিমুখে অতর্কিত হামলা শুরু করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এই গোষ্ঠীর যোদ্ধারা ইসরায়েলি ভূখণ্ড ভেদ করে দেশটিতে তাণ্ডব চালায়। এতে প্রাণ হারান অন্তত ১২শ জন। একইদিন ২৫০ জনকে জিম্মি করে হামাসের যোদ্ধারা।
জবাবে পরদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। ২০২৩ সাল পেরিয়ে ২০২৪ সালও প্রায় শেষ, কিন্তু সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অবিরাম হামলায় নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৫ হাজার। আহত হয়েছেন আরও লক্ষাধিক। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি।
লেবাননে ইসরায়লের অতর্কিত হামলা ও অভিযান
গাজার পাশাপাশি লেবাননেও ব্যাপক হামলা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত সেপ্টেম্বরে ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠীর পেজার ও ওয়াটকিতে বিস্ফোরণ ঘটায় ইসরায়েল। এতে নিহত হন ৪২ জন, সেইসঙ্গে আহত চার হাজার।
এরপরই লেবানন-ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। গত ১ অক্টোবরে লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। সেইসঙ্গে লেবাননজুড়ে হিজবুল্লাহর বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে।
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর গত ১৩ মাসের যুদ্ধে অন্তত ৩ হাজার নিহত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় গত নভেম্বরে দুইপক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে।
ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা
২০২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ইসরায়েল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কেন্দ্র করে। গত এপ্রিল মাসে ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালায় ইরান। সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে হামলার জবাব ছিল এ হামলা।
গত অক্টোবরে ইসরায়েলে অন্তত ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে ইরান। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়, হামাসের রাজনৈতিক নেতা, হিজবুল্লাহর লিডার ও তাদের এক কমান্ডারকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে।
জবাবে গত ২৬ অক্টোবর ইরানে অতর্কিত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এতে ইরানের চার সেনা ও একজন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। সেইসঙ্গে ইরানের অনেক সামরিক স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ইসরায়েলের। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলা ঘিরে মধ্যপ্রাচ্য থমথমে।
ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চলতি বছর সর্বপ্রথম হত্যাচেষ্টা চালানো হয় গত জুলাইতে। এর দুই মাস পর গত সেপ্টেম্বরে আবার ট্রাম্পের ওপর হত্যাচেষ্টা চালানো হয়। ফ্লোরিডায় নিজের মালিকাধীন মাঠে গলফ খেলার সময় ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। তবে এবারও তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই ঘটনায় রায়ান ওয়েলসি রুথ নামে ৫০ বছর বয়সী একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে গত নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টায় একজন ইরানিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও ইরানের পক্ষ থেকে এই দাবি নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের নতুন করে ক্ষমতায় আসা এবং ইরানের সঙ্গে প্রথম মেয়াদের ট্রাম্পের যে কট্টর ইরানবিরোধী অবস্থান তাতে সামনে কী হতে যাচ্ছে তা দেখার অপেক্ষা।
সিরিয়ায় আসাদের পতন
বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ঝড়ো আক্রমণের মুখে গত ৮ ডিসেম্বর মাত্র ১২ দিনের মধ্যে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। এতে সিরিয়ার বাশার পরিবারের ৫৩ বছরের যে রাজত্ব তা ভেঙে চুরমার হয়েছে। যদিও পতনের দিনেই সিরিয়া ছেড়ে রাশিয়ায় পরিবারসহ পালিয়েছেন আসাদ। তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বহু বছর ধরে তাকে সামরিকভাবে সহায়তা করে আসছিল রাশিয়া ও ইরান।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনি দাবি করেছেন, আসাদের পতনে পেছনে দায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। তবে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ায় ক্ষমতার পালাবদলের পেছনে তুরস্ককে ক্রেডিট দিয়েছে।
এদিকে এরইমধ্যে ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমির বাফার জোন দখল করে নিয়েছে। সেইসঙ্গে সিরিয়ার আরও এলাকাও দখল করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় পাঁচ শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়ায় শক্তিশালী অনেক রাষ্ট্রের স্বার্থ আছে। তাই সহসাই সিরিয়ায় শান্তি ফিরে আসছে না সিরিয়া বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হচ্ছে- এমন আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
ইয়েমেনজুড়ে আশঙ্কা
গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে লোহিত সাগরে বিভিন্ন জাহাজ, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা ও ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে আসছে ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি। তাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র মাঝে মধ্যেই ইসরায়েলে এসে পড়ছে। এর জবাবে ইয়েমেনজুড়ে হুতিদের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
এ ছাড়া ইয়েমেনজুড়ে ২০২৪ সালে কয়েক দফায় যৌথ হামলা চালিয়েছে যুক্তরাজ্য ও মার্কিন বাহিনী। সম্প্রতি ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, হামাস, হিজবুল্লাহ নেতাদের মতো হুতি নেতাদেরও শিরচ্ছেদ করা হবে।
ভারত-কানাডা দ্বন্দ্ব
শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ভারত ও কানাডার মধ্যে চলতি বছর সম্পর্ক চরম উত্তেজনায় রুপ নেয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত অক্টোবরে দাবি করেন, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারত সরকার সহযোগিতা করছে না।
সেইসঙ্গে কানাডার মাটিতে সহিংসতার পেছনে ভারতের এজেন্টরা জড়িত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে- এমন দাবি করেন ট্রুডো। তবে ভারত কানাডার সব অভিযোগ উড়িয়ে দেয়।
দেশ দুইটির কূটনীতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। কানাডা ভারতের ছয়জন কূটনীতিবিদকে বহিষ্কার করে। এর জবাবে ভারতও কানাডার কূটনীতিবিদদের বহিষ্কার করেছে। ২০২৪ সাল প্রায় শেষ হতে চলেছে কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক এখনো তলানিতেই রয়েছে।
গৃহযুদ্ধে উত্তাল মিয়ানমার
২০২১ সালে সামরিক ক্যু'য়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলে নেয় দেশটির জান্তা বাহিনী। এরপর থেকে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। তবে সাম্প্রতিক সময় সংঘর্ষের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। চলতি ডিসেম্বরেই দেশটির রাখাইন রাজ্যের উত্তর সীমান্ত এলাকা পুরোপুরি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে দেশটিতে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। গত মে মাসে ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার জান্তার দখলে ৫০ শতাংশেরও কম এলাকা।
গত ২০ ডিসেম্বর বিবিসির অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের এক চতুর্থাংশেরও কম ভূখণ্ডের ওপর সেনাবাহিনীর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সামরিক ক্যু-এর পর ২০ হাজারের বেশি জনকে আটক করেছে জান্তা সরকার। সেইসঙ্গে হাজার হাজার ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী হামলায় টালমাটাল পাকিস্তান
দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানেও ২০২৪ সাল জুড়ে চলমান ছিল নানা অস্থিরতা। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানের মুক্তি নিয়ে বছরজুড়ে আন্দোলনে হয়েছে।
পিটিআই'র বিক্ষোভ দমাতে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে। ইসলামাবাদে জমায়েত ঠেকাতে জারি করেছিল ১৪৪ ধারা। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবাও। তবে এরপরেও পিটিআই সমর্থক ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
গত নভেম্বরে বিক্ষোভে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল চারজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। এছাড়া দেশটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। পাকিস্তান এসব হামলার জন্য তাদের নিষিদ্ধ ঘোষিত তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) দায়ী করে।
বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) আফগানিস্তানের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এতে অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অনেকে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে আফগানিস্তান।
টিটিপি'কে লক্ষ্য করে হামলা করা হয়েছে বললেও আফগানিস্তান বলছে, বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এর পাল্টা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ার বার্তা দিয়েছে আফগানিস্তান। তাই বছর শেষ হওয়ার আগে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিলো। সূত্র: ইত্তেফাক
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।