শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

দেশে যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১৫:৫০

ছবি: সংগৃহীত

যারা প্রাণপ্রকৃতি ভালোবেসে শান্তি পান। শহুরে জীবনের কোলাহল থেকে স্বস্তিদায়ক গন্তব্য চান। তাদের পদভারে মুখরিত এখন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ভ্রমণপিপাসুদের আনন্দ-উন্মাদনায় পুরো সৈকত জুড়ে চলছে উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রকৃতি যেন দুহাত মেলে তার রূপ-সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছে সৈকতজুড়ে। কুয়াকাটা এমন রূপ-রস-সৌন্দর্য বিলাচ্ছে বছরের পর বছর। তাই বলা যায়, প্রকৃতি যে কতটা উদার কুয়াকাটা না ঘুরলে বোঝা সম্ভব নয়।

একইস্থানে দেখা মিলবে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তঃ

এটিই দেশের একমাত্র নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। সাগরের বুক চিরে সকালেই দিনের তেজি সূর্যটা আলো ছড়াতে শুরু করে। আবার সন্ধ্যায় সাগরের কোলে আশ্রয় নেয় লাল থালার মত হলুদাভ সূর্য। দিনের আলোয় কখনও লাল, কখনও সোনালি রঙ সাগরের জলে ভর করে। নীল আকাশের রঙেও রাঙিয়ে তোলে কখনও কখনও। আর দক্ষিণের মৃদু বাতাস মন ও শরীর দুলিয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। শান্ত সমুদ্রে স্নান আর মিষ্টি রোদে পর্যটকদের ক্লান্তিহীন ছুটোছুটি চলে অবিরাম। নির্জন এই সমুদ্র সৈকতে প্রকৃতির কলতানে হারিয়ে যেতে তাই কোনও বাঁধা নেই।

কুয়াকাটার কুয়ারে রহস্য উন্মোচনঃ

কুয়াকাটা যাবেন আর কূপ দেখবেন না তা কী হয়! কুয়াকাটা নামকরণের পেছনে থাকা ঐতিহাসিক কুয়াটি আজও টিকে আছে। সেটি দেখতে যেতে হবে রাখাইনদের বাসস্থল কেরাণিপাড়ায়। বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশের মুখে কুয়াটির অবস্থান। অনেকেরই অজানা কুয়াকাটা নামটি এল কীভাবে। আসলে কুয়াকাটা নামের পেছনে আছে এক রহস্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশে আরাকানদের আগমনের ইতিহাস। প্রচলিত আছে, এখানে সমুদ্র উপকূলে মিষ্টি পানির সন্ধান পাওয়া গেলেও দূর্ভোগ ছিল ভীষণ। এখানে কুয়া কাটা হত ঠিকই, কিন্তু বালি দিয়ে তৈরি বাঁধ ভেঙ্গে যেত। তাই রাখাইনরা নিজেদের দূষতো ভাগ্য বঞ্চিত হিসাবে। রাখাইন ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় ক্যাওয়েছাই। এভাবেই কুয়া কাটতে কাটতে এই উপকূল অঞ্চলের নাম হয়ে ওঠে ক্যাছাইও, যার বাংলা অর্থ কুয়াকাটা।

নৌকা জাদুঘর: কখনো সোনার নৌকা, কখনো আজব নৌকা, আবার কখনো রাখাইন নৌকা। যেই নামেই ডাকা হোক না কেন ২০০ বছরের বেশি সময় পানি আর মাটির নিচে চাপা থাকা বিশালাকৃতির এই আদি নৌকাটি এখনও পর্যটকদের প্রধান আগ্রহের বিষয়। প্রাচীন এ নৌকাটি দর্শনে প্রতিদিন তাই ভিড় করেন পর্যটক-দর্শনার্থীরা।

জাহাজটি জারুল কাঠের তৈরি। কাঠের পুরত্ব সাড়ে ছয় সেন্টিমিটার। কাঠ, লোহা ও তামার পাত দিয়ে তৈরি। ৭২ ফুট লম্বা ২৪ ফুট প্রস্থ এবং ১০ দশমিক ৬ ফুট উচু জাহাজটি। এটি উদ্ধার কালে পাটের তৈরি ছালার নিদর্শন মেলে। পাটখরি, মাদুরের অবশেষ, শিকল ও তামার অসংখ্য পাত পাওয়া যায়। ভাঙ্গা মৃৎপাত্রের টুকরা, লোহা দস্তার তৈরি ব্যালাস্ট পাওয়া যায়। জাহাজটিকে সোনার নৌকা বলা হয়। কারণ এর বাইরের আবরণ তামার পাতে মোড়ানো ছিল বলে মানুষ এটি নামকরণ করে।

রাখাইনদের দাবি এ জাহাজটি তারা দুইশ বছর আগে ব্যবহার করেছেন। মতান্তরে সাধু সওদাগরদের ধান-চালের সওদার কাজে ব্যবহার করা নৌকা। আবার কেউ বলে থাকে পর্তুগীজদের ব্যবহৃত পাল তোলা ছোট্ট জাহাজ।

২০১২ সালে কুয়াকাটা সৈকতের ঝাউবাগান লাগোয়া বেলাভূমের নিচ থেকে স্থানীয় জেলেরা প্রথমে প্রাচীণ এ জাহাজটি দেখতে পায়। ২০১৩ সালে কুয়াকাটা বৌদ্ধমন্দির লাগোয়া বেড়িবাঁধের পাশে সংরক্ষণ করা হয় ৬২ হাত দীর্ঘ ও ১৬ হাত চওড়া ঐতিহ্যবাহী সাম্পানটি। ধারণা করা হচ্ছে, দুইশ বছরের আগে রাখাইনরা এই ছোট জাহাজে করেই কুয়াকাটায় এসে বসতি গড়েছিল। কালের বিবর্তনে রাখাইনদের নানা স্মৃতি হারিয়ে গেলেও জাহাজটি এ অঞ্চলের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।

শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার: কুয়ার পাশেই রয়েছে ইন্দো-চীনের আদলে একটি বৌদ্ধমন্দির। যা শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার নামে পরিচিত। নয়টি ধাতুর সমন্বয়ে তৈরি এই বৌদ্ধ মূর্তিটি। শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার চুনদ্রী দেবী, শাক্য রাজা ও ছিওয়ালি আর্হাং বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশের মুখে দাড়ান দুইটি মূর্তি রয়েছে। এগুলো চুনদ্রী দেবীর। রাখাইনদের ধর্মীয় বিশ্বাসে চুনদ্রী দেবী মন্দিরের রক্ষাকর্তা। উপরের দিকে সিড়ির শেষ প্রান্তে রয়েছে শাক্য রাজার মূর্তি।

মিশ্রিপাড়া সীমা বৌদ্ধ বিহার: কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে সাত কিলোমিটার পূর্ব দিকে মিশ্রিপাড়ায় রাখাইন পল্লী অবস্থিত। জানা যায় প্রভাবশালী মিশ্রি তালুকদারের নামে এ পল্লীটির নামকরণ করা হয়। এখানকার বৌদ্ধমন্দির যা সীমা বৌদ্ধ বিহার নামে পরিচিত। এ-বিহারের মধ্যে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন ১৩৭ মন ওজনের অষ্টধাতু নির্মিত বিশাল আকৃতির বৌদ্ধমূর্তি শোভা পাচ্ছে। রাখাইনদের দাবি, এটি দুশো বছরের পুরাতন বৌদ্ধমূর্তি ও ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ মূর্তি।

ক্ষুধা নিবারেণে ভোজন সন্ধানেঃ

ভ্রমণ শেষে ক্লান্ত শরীর আর ক্ষুধা নিয়ে পেট পুরে খেতে ইচ্ছে করেনা এমন মানুষের জুড়ি মেলা ভার। সৈকতের হোটেলগুলোর খাবার রীতিমতন মুগ্ধকর, দামও সাধ্যের মধ্যে। ভোজন রসিকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে থাকে সৈকতের ছোটবড় ফুডকোর্ট। এখানে বসে সাচ্ছন্দ্যে ক্ষুধা নিবারন করেন দুর—দুরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। রকমারী মাছ, ডিমভর্তা ভাজি মিলে যেন একবারে নিজের ঘরের রান্না।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক মোহময় লীলাভূমির নাম কুয়াকাটা। এখানে সর্বত্রই হৈ-হুল্লোড় চলে আগতদের। সাগরের হিম শীতল পানির স্পর্শে শরীরে শিহরণ জাগায়। নির্মল আনন্দ আর গভীর প্রশান্তি পেতে মানুষ এখানে প্রকৃতির সান্নিধ্য খুঁজে বেড়ায়। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে, ক্লান্তি ও মনের জড়তা ঘুচিয়ে দেয়। বেলাভূমির একই স্থানে দাড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখার একমাত্র জায়গা কুয়াকাটা। এখানেই দেখা যায় সমুদ্রের পেট চিড়ে কিভাবে সূর্য উঠে তার বিরল দৃশ্য। নিজের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে কুয়াকাটায় ভ্রমণের তাই বিকল্প নেই। আপনি যদি ভ্রমণ পিপাসু হন তাহলে কুয়াকাটার সৌন্দর্য আপনাকে অবশ্যই টানবে এবং মুগ্ধ করবে। শহর ছেড়ে দুদণ্ড শান্তির জন্য তাই দেরি না করে ঘুরে আসতে সাগরকন্যা কুয়াকাটায়।

 

 

 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top