আজ শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়
নিউজফ্ল্যাশ ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১৩
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম রায় হতে যাচ্ছে। এ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘সুনির্দিষ্ট পাঁচটি’ অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।
আজ (সোমবার) মামলার রায়ে জানা যাবে, এসব অভিযোগ কতটা প্রমাণ করতে পেরেছে প্রোসিকিউশন।
গত ১৩ নভেম্বর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণার এই দিন ধার্য করেছিলেন। মামলার অন্য দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে এই মামলার বিচারকাজই প্রথম শেষ হতে যাচ্ছে।
গত ২৩ অক্টোবর প্রোসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনি যুক্তিতর্ক শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখেন। সেদিন ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, ‘১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার তারিখ ঘোষণা করা হবে। তবে সেটা (রায় ঘোষণা) হবে খুব তাড়াতাড়ি।’ সেই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ নভেম্বর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল আজ ১৭ নভেম্বর (সোমবার) রায়ের দিন ঘোষণা করেন।
ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়ার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের কাছে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ চাওয়া হয়েছে প্রোসিকিউশনের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তাঁদের বেকসুর খালাস চেয়েছেন।
রায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে : সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলার বিচারকাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং চিফ প্রোসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় মামলার রায় ঘোষণার অংশবিশেষও সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে জানিয়েছে প্রোসিকিউশন।
গতকাল রবিবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে এমনটাই জানিয়েছেন প্রোসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইতিমধ্যে আপনারা দেখেছেন, এই মামলার স্পেশাল প্রোসেডিংসগুলো (বিশেষ কার্যধারা বা বিচারকাজের বিশেষ অংশ) আমরা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে সরাসরি সম্প্রচার করেছি। আগামীকাল (আজ সোমবার) রায়ের যে অংশটুকু ট্রাইব্যুনাল পড়ে শোনাবেন, সে অংশটুকুও ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে। আর বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ যে কয়েকটি সংস্থা আছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে এ দেশের সব গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।’
সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ আসতে পারে রায়ে : রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়ার পাশাপাশি তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত চেয়েছে প্রোসিকিউশন। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রোসিকিউটর তামীম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংশোধনীর আগে আইনটির নাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন হলেও সেখানে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো প্রযোজ্যতা ছিল না। জুলাই অভ্যুত্থানের পরে আইনটি সংশোধন করে রোম-সংবিধিতে আন্তর্জাতিক আইনের যে সংজ্ঞা, সেই সংজ্ঞা এবং অ্যাপ্লিকেবিলিটি (প্রযোজ্যতা), সেটি এখানে প্রযোজ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া দণ্ডের পাশাপাশি অর্থাৎ কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আরেকটি দণ্ডকে আইনে সংযোজন করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে, আসামিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভিকটিম (ভুক্তোভোগী) অর্থাৎ ঘটনায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের বরাবর হস্তান্তর করা।’
ট্রাইব্যুনাল যে রায় ঘোষণা করবেন তা মেনে নেওয়ার জন্য প্রোসিকিউশন প্রস্তুত আছে উল্লেখ করে গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, ‘এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে প্রোসিকিউশন। যে কারণে প্রোসিকিউশন আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা করেছে ট্রাইব্যুনালের কাছে। শুধু তা-ই নয়, আসামিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এই মামলায় বা এই ঘটনায় যাঁরা ভিকটিম (ভুক্তভোগী) আছেন, তাঁদের বরাবর হস্তান্তরের প্রার্থনা আমরা জানিয়েছিলাম। ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচারের স্বার্থে যে আদেশ দেবেন, সেটা প্রোসিকিউশন মেনে নেবে।’
পলাতক অবস্থায় আপিল করতে পারবেন না : এ মামলার আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান পলাতক। তাঁদের সাজা হলে আপিল করার সুযোগ থাকবে কি না, এসংক্রান্ত এক প্রশ্নে প্রোসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার বলেন, অবশ্যই না। এ মামলার যেসব আসামি পলাতক আছেন, তাঁরা গ্রেপ্তার হওয়া ছাড়া আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন না।
মামলার প্রধান আসামি একজন নারী। নারী হওয়ার কারণে আইনে বিশেষ কোনো সুবিধা তিনি পাবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিআরপিসিতে জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ, কিশোর, বালক, শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীকে সাধারণ আইনেও কোনো আলাদা প্রিভিলেজ (অগ্রাধিকার) দেওয়া হয় না। ট্রাইব্যুনাল আইনেও কোনো আলাদা প্রিভিলেজ নেই। অতএব, রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আসামি নারী হোক, পুরুষ হোক, তিনি তাঁর অবস্থানে থেকে কী অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধের গ্র্যাভিটি বিবেচনা করে শাস্তি প্রদান করা হবে বা মামলা প্রমাণ না হলে খালাস প্রদান করা হবে।
আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ : পাঁচ অভিযোগেই আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যা-চেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। আর এসব অপরাধ তাঁরা করেছেন গত বছরের ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সময়ের মধ্যে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, চীন থেকে ফিরে গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন শেখ হাসিনা। ওই সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে রাষ্ট্রীয় এবং সহযোগী বাহিনীগুলোকে উসকানি দেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন অধীনস্ত বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার জন্য ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশে অধিনস্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সহযোগী বাহিনী ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, হত্যা-চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, যা আসামিদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ দেন আসামি শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীনস্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে শেখ হাসিনার নির্দেশনা কার্যকর করেন। এর মধ্য দিয়ে আসামিরা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, অপরাধ সংঘটনে সহায়তা, অপরাধে সম্পৃক্ত হয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন, যা তাদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের অংশ হিসেবে গত বছর ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পুলিশ। পরে চাপ প্রয়োগ করে তাঁর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলাও করে পুলিশ। ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের অংশ হিসেবে গত ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলার সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে। আর এই হত্যার মাধ্যমে আসামিরা হত্যার নির্দেশ, হত্যায় প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের অংশ হিসেবে গত ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় ঢাকার আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এতে নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনের মৃত্যু হয়। পরে তাঁদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ এই তিন আসামি জ্ঞাতসারে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মিছিল : এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে গতকাল রবিবার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে মিছিল করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। গতকাল দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সামনে থেকে তাঁরা মিছিলটি শুরু করেন। মিছিলটি সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে দিয়ে আবার সমিতি ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
মামলার আদ্যোপান্ত ; গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২৫ মে থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে যেসব মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তার মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা আটটি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারাধীন পাঁচটি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এই মামলাটি ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় মামলা।
গত বছর ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। তখন ওই সরকার ঘোষণা দেয়, এই অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। ঘোষণা অনুযায়ী পরে ট্রাইব্যুনাল, প্রোসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল গত বছর ১৭ অক্টোবর দুই মামলার বিষয়ে প্রথম শুনানি হয়। সেদিন প্রোসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ এই ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তার আগে গত বছর ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রোসিকিউশনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষ করে গত ১২ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলি (ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়), হত্যা, হত্যা-চেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, অপরাধে প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিহত না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগে অভিযোগ আনা হয়।
গত ১ জুন প্রোসিকিউশন ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করলে তা আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে আত্মসমর্পণ করতে ১৬ জুন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরদিন সেই বিজ্ঞপ্তি দুটি জাতীয় সংবাদপত্রে ছাপা হয়। আত্মসমর্পণ না করায় তাঁদের পলাতক দেখিয়ে গত ১০ জুলাই মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী মো. আমির হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই দিন আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এ মামলার রাজসাক্ষী হতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন। পরে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
গত ৩ আগস্ট চিফ প্রোসিকিউটরের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচারকাজ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্য দেন এ মামলায়। রাজসাক্ষী হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন আসামি চৌধুরী মামুন। গত ৮ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। টানা পাঁচ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রোসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত ১৬ অক্টোবর প্রোসিকিউশনের যুক্তিতর্ক শেষ হলে ২০ অক্টোবর থেকে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টানা তিন দিন শেখ হাসিনা-কামালের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ অক্টোবর পাল্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন দুই পক্ষই। তার আগে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ট্রাইব্যুনালে সমাপনী বক্তব্য দেন। সেদিন ট্রাইব্যুনাল জানিয়ে দেন, ১৩ নভেম্বর রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হবে। সেই ধারাবাহিহকতায় গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানিয়ে দেন আজ (সোমবার) মামলাটির রায় ঘোষণা করা হবে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারের অপেক্ষায় আরো দুই মামলা : জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের পাশাপাশি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধেরও বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এরই মধ্যে এসংক্রান্ত দুটি মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রোসিকিউটর কার্যালয়। দুটি মামলাতেই আসামি করা হয়েছে সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিককে।
বিষয়:

পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।