গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:৫২
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এসব গুলির ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার আর এসবের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ সদস্য। গণমাধ্যম সূত্রে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।
আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি অংশ নেওয়া ও নেতৃত্বদানকারী ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় গত ১৩ আগস্ট থেকে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ২৮৪টি মামলা করা হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানায়, ৯১টি। সম্প্রতি কয়েকজন মাস্টারমাইন্ড পুলিশ সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮টি মামলা হয়েছে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদের নামে। এর পরের অবস্থানে রয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তার নামে মামলা হয়েছে ৩৬টি। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নামে মামলা হয়েছে ৩৩টি, ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ২৭টি, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মনিরুল ইসলামের নামে ১১টি, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইনের নামে আটটি মামলা হয়েছে।
এই ছয়জন হাই প্রফাইল পুলিশ সদস্যের মতো আরো শতাধিক পুলিশ সদস্য সরকারের কাছ থেকে আন্দোলন দমাতে যে মাত্রার নির্দেশনা পেয়েছেন, প্রয়োগ করেছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এ পর্যন্ত এ ধরনের ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে মামলা হলেও আরো বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের নামে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা ও মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করার দায়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে, মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাত ১২টার দিকে উত্তরা ও কচুক্ষেত থেকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তাদের দু’জনের বিরুদ্ধেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র হত্যার অভিযোগে হত্যা মামলা করা হয়। এ ছাড়া, তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও আছে।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা
সরকার পতনের পর ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালকে ব্রিফ করছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইন। তাঁর মোবাইলে একটি ভিডিও দেখিয়ে বলছিলেন, ‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ এ সময় সেখানে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনও উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে গত ১৯ জুলাই বিকেলে রাজধানীর নিউ মার্কেটের পাশে নীলক্ষেত মোড়ে আব্দুল ওয়াদুদ (৪৫) নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার দায়ে তাঁর স্বজন আব্দুর রহমান বাদী হয়ে ২১ আগস্ট নিউ মার্কেট থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
ওই মামলায় সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন ও ডিএমপির লালবাগ বিভাগের ডিবি ডিসি মশিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মশিউরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বাণিজ্য, হয়রানি, মানহানি ও পোস্টিং বাণিজ্যসহ আরো একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন বিকেলেও গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এসব গুলিতে অনেকে নিহত হয়েছেন। নিহতের অনেকের মরদেহের হদিস পর্যন্ত মেলেনি এখনো। এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন মো. হৃদয় (২০) নামের এক কিশোর। ঘটনার দিনের একটি ভিডিও সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ছেলেটিকে গুলি করার পর বস্তায় ভরে থানা নিয়ে যায় পুলিশ। ওই দিন তাঁর মতো আরো কয়েকজনের মরদেহ গুম করেছে থানা পুলিশ।
একইভাবে ৫ আগস্ট দুপুরের পর ঢাকার আশুলিয়া থানার প্রধান ফটকসংলগ্ন স্থানে একটি ভ্যানে রাখা ছিল বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ। ওই ভ্যানেই হাত-পা ধরে পুলিশকে আরেকটি লাশ তুলতে দেখা গেছে। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে ওই দিনের ঘটনার এই দৃশ্য দেখা গেছে। পরে ভিডিওটি তদন্তে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটি জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ওই ঘটনায় সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সুপারনিউমারারি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবদুল্লাহিল কাফীকে গত সোমবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। গতকাল কাফীর বিরুদ্ধে লাশ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা এবং হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।