বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে উদযাপতি হয় ঈদ
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:২১
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর।
দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর আসে আনন্দের এই দিন। এ কারণে মুসলিমদের কাছে এই ঈদের বিশেষত্বও বেশি। ‘ফেস্টিভ্যাল অব ব্রেকিং দ্য ফাস্ট’ হিসেবে ঈদুল ফিতরকে আখ্যা দেয়া বিশ্বব্যাপী। পুরো বিশ্বই যেন ঈদের খুশি ও আনন্দে মেতে ওঠে। ঈদ মানেই স্বজন-বন্ধুর সঙ্গে খুশির মুহূর্ত ভাগাভাগি।
দেশে দেশে ঈদগাহে খোলা আকাশের নিচে হাজারো মানুষ সমবেত হন। বেশিরভাগ মানুষের পরনে থাকে ঈদের নতুন জামা। মনে উৎসবের আমেজ। ঈদগাহে সমবেত হয়ে একসঙ্গে তারা নামাজ আদায় করেন। দেশ, জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য দোয়া করেন। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে খোদার প্রশংসা করেন। নামাজের পর কোলাকুলি করেন।
তবে ঈদ পালনের কিন্তু একেক দেশে একেক রীতি। ঈদ উদযাপনের সেই ভিন্নতাই আজ জানবো। চলুন জেনে নেয়া যাক বিশ্বের কোন দেশে কীভাবে ঈদ উদযাপন হয়।
সৌদি আরব
ঈদের নামাজ আদায়, নতুন পোশাক, ঐতিহ্যবাহী খাবার, অসহায়দের সাহায্য আর প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ঈদ উদযাপন করা হয় সৌদি আরবে। ঈদ উপলক্ষে দেশটিতে তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়ি-ঘর সাজানো, ঈদ সেলামি, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন, অতিথি আপ্যায়নসহ নানা আয়োজন থাকে দেশটিতে।
ঈদের নামাজ শেষে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় সৌদিবাসী। আমাদের দেশের সালামির মতো এ সময় প্রিয়জন বিশেষ করে শিশুদের দেওয়া হয় অর্থ, খেলনা ও নতুন পোশাকের মতো বিভিন্ন উপহার। এমনকি অমুসলিমদের উপহার দিতেও তারা ভুলেন না।
ঈদের নামাজ শেষে বাড়িতে বিশেষ খাবার রান্না হয়। তৈরি হয় ভেড়ার মাংস আর টমেটোর সমন্বয়ে তৈরি সুস্বাদু ঐতিহ্যবাহী খাবার মুগালগাল। আরও তৈরি করা হয় মসলাযুক্ত মাংসের সঙ্গে গম দিয়ে তৈরি জারেশ। সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী আরব দেশের মিষ্টি জাতীয় খাবার তো রয়েছেই।
ঈদের দিন সৌদি মুসলিমরা অসহায় ও দুস্থদের সাহায্য করে থাকে। এটা দেশটির ঈদ উদযাপনের অংশ। মানুষের মাঝে উদারতার কোনো কমতি থাকে না এই দিনে। এদিন তারা বাজার থেকে বেশি পরিমাণে চাল কিনে আনে। আর তা বাড়ির প্রবেশ দরজার বাইরে রেখে দেয়। যেন অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মানুষ তা নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে পারে। এছাড়াও এই দিনটিতে গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণও করা হয়।
ঈদ উপলক্ষে এই দিনে অনেক দোকানি ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড়া দেন।
ইন্দোনেশিয়া
জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত আড়ম্বরপূর্ণভাবে সেখানে ঈদ উদযাপন হয় না। ঈদ বলতে আমরা যা বুঝি, ইন্দোনেশিয়ায় সেটির একশ ভাগের এক ভাগও নেই। ঈদ নিয়ে উচ্ছ্বাস, আবেগের দেখা মেলে না। লোকজন ব্যস্ত যে যার প্রাত্যহিক কাজে। আজ কি ঈদ? প্রশ্ন করলে অনেকে বুঝতেও পারেন না। বুঝিয়ে বলার পর কেউ কেউ হয়তো বললেন, ‘ইয়েস ইয়েস, টু ডে ঈদুল ফিতর। ’
বাংলাদেশে যেমন ঈদ ব্যানার-ফেস্টুনের শুভেচ্ছায় রাস্তাঘাট ভরিয়ে ফেলা হয়, তবে ইন্দোনেশিয়ানরা এই সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে।
অন্যান্য দেশের মতেই মিশরে ঈদুল ফিতর শুরু হয় ঈদের নামাজ পড়ার মাধ্যমে। এরপর পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সঙ্গে যুবকদের দেখা করার নিয়ম আছে। এ সময় প্রবীণরা পরিবারের অল্পবয়সীদেরকে একটি ছোট টোকেন বা সালামি দেয়। অনেক মিশরীয়রা ঈদ উদযাপনের জন্য সরকারি বিভিন্ন উদ্যান এবং চিড়িয়াখানায় পরিবারসহ ঘুরতে যান। গিজা চিড়িয়াখানা সবার জন্যই অন্যতম জনপ্রিয় এক স্থান।
নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে ঈদুল ফিতরের উৎসব শুরু হয় সকালের নামাজের মধ্য দিয়ে। তারপরে ইডেন পার্কে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাই অ্যানুয়াল ঈদ ডে’। সেখানে বিভিন্ন আয়োজন দেখতে একে একে ভিড় জমান নিউজিল্যান্ডবাসী। সেখানে বিভিন্ন কার্নিভালের আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন খাবারের দোকান বসে।
সিঙ্গাপুর
গিলং সেরাইকে কেন্দ্র করেই সিঙ্গাপুরের ঈদুল ফিতরের উৎসব পরিপূর্ণতা পায়। সেখানেই সব মুসলিমরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ভিড় জমায়। ১০০ এরও বেশি খাবারের দোকান বসে। যেখানে ঐতিহ্যবাহী মালয় খাবার পরিবেশন পাওয়া যায়। চোখ ও পেট ভরাতে সিঙ্গাপুরে একবার হলেও ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে পারেন।
আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডবাসী ঈদের দিনও রোজা থাকেন। কারণ গ্রীষ্মের শুরুতে সূর্য স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকায় মধ্যরাতে সূর্যাস্ত যায় সেখানে। আইসল্যান্ডে বসবাসরত মুসলমানরা প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা রোজা রাখে। যদিও এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তবে ইসলামিক নির্দেশনা অনুযায়ী, তারা নিকটতম দেশের সূর্যাস্তের সময়কালের ভিত্তিতে রোজা ভাঙেন।
আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকজাভাকের কয়েকটি মসজিদে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। মসজিদের আশেপাশের এলাকাতেই অতিথিদের সমাগম ঘটে। সেখানেই তারা পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন। এ সময় তারা ইন্দোনেশিয়ান, মিশরীয় এবং এরিটরিয়ানে বিভিন্ন খাবার ও পানীয় খেয়ে থাকেন। শিশুরা নতুন পোশাক পরে ছোটাছুটি করে। এভাবেই আইসল্যান্ডবাসীরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন।
মরক্কো
অন্যান্য দেশের মতো মরক্কোতেও সকালে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের নামাজ শেষে পারস্পারিক খোঁজ-খবর নেওয়া একটি সাধারণ রীতি। দেশটিতে ঈদে যে বিশেষ খাবার খাওয়া হয়, তার নাম ‘তাজিন’। ঐতিহ্যগতভাবে এই রান্নাতে ব্যবহার করা হয় মাটির পাত্র, যেটার নাম তাজিন। আর ওই মাটির পাত্রের নামানুসারে রান্নার নামকরণও হয়েছে তাজিন। সাধারণত ভেড়া ও গরুর মাংস দিয়ে তৈরি করা হয় এই খাবারটি। তবে মাংসের সঙ্গে নানারকম সবজি ও মশলার মিশ্রণও থাকে এতে। এই খাবার দিয়েই বেশিরভাগ অতিথি আপ্যায়ন করেন তারা।
ইরান
ইরানে ঈদুল ফিতর উদযাপন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য এবং আনন্দের উপলক্ষ। এ দিন দেশটির পরিবার এবং সম্প্রদায়গুলো মসজিদে বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দেয়। শুভেচ্ছা বিনিময় করে। প্রিয়জনদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খায়। ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ও খাবারগুলি প্রস্তুত করা হয়। অপক্ষেকৃত স্বচ্ছলরা অভাবি ব্যক্তিদের খাবার দেন, সাহয্য দেন।
এই দিনে পুরুষরা কান্দর নামের সাদা পোশাক পরিধান করে মাথায় দেয় গাহফিহ নামের টুপি। নারীরা এই দিনে থাউব নামের বিশেষ পোশাক পরে থাকে।
আফগানিস্তান
ঈদের দিনে আফগানরা অতিথিদের খেতে দেন 'জালেবি' নামের এক বিশেষ খাবার। আর ‘তখম জাঙ্গি’ আফগানদের ঈদ উদযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেখানে পুরুষেরা ফাঁকা ময়দানে একত্রিত হয়ে একজন আরেকজনের দিক সিদ্ধ ডিম ছোড়ে।
মালয়েশিয়া
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়ায় ঈদ-উল-ফিতর বড় করে উদযাপিত হয়। এ সময় সরকারি ছুটি থাকে। সবাই নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করে। এখানে ঈদের আগের দিন থেকেই উৎসব পালিত হয়। ঈদের আগের রাতকে তাকবিরান বলা হয়। মসজিদ ও রাস্তায় তাকবির ধ্বনি উচ্চারিত হয়। রাস্তাঘাটে মশাল, আতশবাজি করা হয়। তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার রেন্দাং, কেতুপাট, লেমাং রান্না করে। শহরে ঘরে ঘরে প্রচুর পরিমাণে খাবার রান্না করে প্রতিবেশী এমনকি অমুসলিমদেরই দাওয়াত দেওয়া হয়। খাওয়ার পর গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চীন থেকে বাঁশি আমদানি করা হয়। এ বাঁশি খুব জোরে বাজে। সন্ধ্যায় বাজি উৎসব চলে।
তুরস্ক
বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তুরস্ক। এদেশের বেশিরভাগ জনসংখ্যাই মুসলিম। তুরস্কের ঈদ উদযাপন সম্পর্কে জানলে আপনি রীতিমতো অবাক হয়ে যাবেন। তুর্কিবাসীরা ঈদ উদযাপন করেন সমুদ্র সৈকতে। তপ্ত রোদে সমুদ্র সৈকতে এসে ভিড় জমান সবাই। ঈদের ছুটি কাটাতে তুরস্কের বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে পরিবারসহ সময় কাটান তুর্কিবাসীরা। তুরস্কের জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণ করে।
এ ছাড়াও অনেকে ঈদুল ফিতরের প্রথম দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন এবং ২য় ও ৩য় দিন তারা সমুদ্রে কাটান। এ সময় তারা মাছ ধরা, সাঁতার কাটাসহ এবং আনন্দ হুল্লোড়ে মেতে ওঠেন। বালুকাময় উপকূলে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখেই পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে থাকেন তুর্কিবাসীরা। ঈদ মানে তাদের কাছে বিশ্রাম, আনন্দ, আবার বিশ্রাম!
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।