কতদিন চলবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ধুঁকছে বিশ্ব
রাজিউর রাহমান | প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১০:১৭
যুদ্ধ থেকে সরে আসার এটাই উপযুক্ত সময়
ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে এক বছর ধরে চলা সংঘাত থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আকস্মিক হামলা চালায় রাশিয়া। তারপর থেকে এই যুদ্ধ চলছেই। এদিকে দু’দেশের মধ্যকার এই সংঘাতের নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস।
তিনি বলেন, এই যুদ্ধ আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাকে উসকে দিচ্ছে এবং বৈশ্বিক উত্তেজনা ও বিভাজনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এছাড়া অন্য সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে এবং বৈশ্বিক সমস্যা আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
তার মতে, এই যুদ্ধ-সংঘাত পরমাণু যুদ্ধের হুমকি তৈরি করছে। তিনি বলেন, যুদ্ধ থেকে সরে আসার এটাই উপযুক্ত সময়। তার মতে, এই যুদ্ধ বৈশ্বিক সংকট আরও বাড়াবে। তিনি বলেন, যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। যুদ্ধই সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের মানুষ ব্যাপকভাবে ভুগছে। ইউক্রেন, রাশিয়া এবং বিভিন্ন দেশের মানুষ শান্তি চায়।
সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন। তার ওই বক্তব্যের পরই গুতেরেস যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানান।
এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট একটি আঞ্চলিক যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তর করতে চায়। আমরা তাদের এ পরিকল্পনা আগেই বুঝতে পেরেছি এবং সে অনুযায়ী আমাদের প্রতিক্রিয়া জানাবো। কারণ, তাদের ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে রাশিয়ার অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে।
মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরপূর্তিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথাও জানান।
পুতিন বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এ সংঘাতে পুরো বিশ্বকে জড়াতে চায়। কারণ তারা ভাবছে, এর মাধ্যমে রাশিয়াকে পরাজিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু তাদের এ ধারণা একেবারেই ভুল। রাশিয়া যেসব প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে, সেগুলোর জবাব অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেওয়া হবে।
এদিকে গুতেরেস বলেন, গত এক বছরে আমরা শুধু সমস্যা আর বিপর্যয় দেখেছি। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের মানুষ ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে সমস্যা, সংকট আরও বাড়বে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
এ বছরই পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করবে রাশিয়া
চলতি বছরই সারমাট পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করবে রাশিয়া। যুদ্ধের বছরপূর্তি সামনে রেখে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ কথা জানিয়েছেন। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। খবর আল-জাজিরার।
২০১৮ সালে পুতিন আরএস-২৮ নামের সারমাট ক্ষেপণাস্ত্রের কথা জানান। এটি সাতান-২ এর অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। গত বছরই এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করার কথা ছিল।
এদিকে সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইউক্রেন সফরের আগে সারমাট ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে রাশিয়া। তবে সে পরীক্ষা ব্যর্থ হয়।
পুতিন জানিয়েছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র শত্রুদের দ্বিতীবার ভাবতে বাধ্য করবে। পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম এই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ১৮ হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ধুঁকছে বিশ্ব
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালানোর নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তারপর থেকেই চলেছে হামলা-পাল্টা হামলা। দেখা গেছে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মনে করা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সবচেয়ে বড় সংঘাত। এরই মধ্যে লাখ লাখ নাগরিক ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছে। বাস্তুচ্যুতির সংখ্যাও কম নয়। এত দিন পরও মনে হচ্ছে এই যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে আমদানিনির্ভর দেশগুলো। কারণ জ্বালানি রপ্তানিতে যেমন রাশিয়া শীর্ষে রয়েছে, তেমনি খাদ্য রপ্তানিতে ছিল ইউক্রেনের অন্যতম অবদান। ইউক্রেনের শস্যের ওপর বিশ্বের অনেক দেশ নির্ভরশীল। তাই দেশ দুটির এমন যুদ্ধে দেশে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী। তৃতীয় বিশ্বে সংকট আরও গভীর।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। বেশ কয়েক মাস ধরেই জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা চলে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে ইউরোপের দেশগুলো। কারণ নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপে জ্বালানির সরবরাহ কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধ রাখা হয় সরবরাহ। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে চাপ বাড়ে। কারণ ইউরোপের দেশগুলো নজর দেয় মধ্যপ্রাচ্যে। বেড়ে যায় চাপ। যদিও এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড তেলের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে নেমেছে। কিন্তু অস্থিরতা কাটেনি। একই অবস্থা রয়েছে এলএনজির ক্ষেত্রেও। এতে বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে।
ইউরোপের কিছু দেশে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর স্পর্শ করে। বেড়ে যায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। এ কারণে ইউরোপের সমৃদ্ধশালী দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানিসহ বেশ কিছু দেশে আন্দোলন হয়েছে। এখনো অঞ্চলটির অনেক দেশ বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে সরে যেতে হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অন্যতম অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। শুরু থেকেই দেশটি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। যত দিন প্রয়োজন তত দিন এই সহায়তা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। কিন্তু মার্কিন বাজারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে হু হু করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিম্ন আয়ের মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গত বছর দেশটিতে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ৯ শতাংশ ছাড়ায়। এ বছর সেখানে ডিমের দাম গত বছরের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। মন্দারও সাক্ষী হয়েছে দেশটি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। বাড়িয়ে চলেছে সুদের হার। দেশটির এই নীতি বিশ্বের অনেক দেশই অনুসরণ করছে। এতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি এই যুদ্ধে দেশে দেশে একদিকে যেমন বেড়েছে অর্থনৈতিক সংকট তেমনি বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেউলিয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কা। একই পথের পথিক এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তান।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পরই পর্যটননির্ভর দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ছিল বৈদেশিক ঋণের বোঝা। তারপর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয় দেশটি। এখনো সাহায্যের জন্য বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ঘুরছে। কবে দেশটি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
পাকিস্তানও দেউলিয়া হওয়ার পথে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক আগেই বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে দেশটি বিলাসবহুল পণ্যের আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জ্বালানির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। সবশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আমদানি করারও ডলারও নেই পাকিস্তানের হাতে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে নানা সময়ে সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বস্ত পাকিস্তান। আইএমএফের শর্ত মেনে জ্বালানিতে ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়েছে দেশটি। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে করোনাসহ সব বাধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। দেখতে হয়, লোডশেডিং। কমে যায় রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হয় জ্বালানির দাম। কমানো হয় ভর্তুকি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষ। যদিও এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা পদক্ষেপে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। যদিও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে রেমিটেন্স ও পোশাকশিল্পের রপ্তানি।
কতদিন চলবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ?
এক বছর ধরে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত চলছে। কবে নাগাদ এই যুদ্ধ-সংঘাতের সমাপ্তি ঘটবে তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এই যুদ্ধ এখনই থামছে না। হয়তো আরও কয়েক বছর ধরে দু’দেশের মধ্যে সংঘাত চলতে পারে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের এক বছর পূর্তি আগামীকাল শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি)। এ বিষয়টি সামনে রেখে বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বক্তব্য দিয়েছেন ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস। তার মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন পরবর্তী বছরেও চলতে পারে।
বেন ওয়ালেস বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে নিজ দেশের সেনাদের প্রাণহানির ঘটনাকে অবহেলা করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, যখন কেউ সীমা অতিক্রম করে এবং নিজের লোকজনের সঙ্গে যা করা হচ্ছে সেটা ঠিক বলে মনে করে, আমার মনে হয় না যে, তাকে থামানো যাবে।
এদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে লন্ডনে অবস্থিত রুশ দূতাবাসের সামনের রাস্তায় ইউক্রেনের পতাকার মতো নীল এবং হলুদ রং করা হয়েছে।
বেন ওয়ালেস বলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে এই আগ্রাসনে প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার সেনা নিহত বা আহত হয়েছে।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ আরও এক বছর চলবে বলে তার মনে হয় কি না। তিনি জানান, তার মনে হয় এই যুদ্ধ আরও ১২ মাস চলতে পারে।
বৃহস্পতিবার ওয়ালেস তার বক্তব্যে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটোর সংঘাত নয় এবং ইউক্রেনে ন্যাটোর পাইলটরা তাদের যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রবেশ করবে না। তবে কিছু মিত্র দেশ ইউক্রেনের বিমানবাহিনীকে যুদ্ধবিমান দিয়ে সহায়তা করতে পারে এমন সম্ভাবনার কথাও বলেছেন তিনি।
সূত্র: জাগোনিউজ| খবর বিবিসির|
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।