‘ন্যাচার’ সাময়িকীর শীর্ষ ১০ জনে ড. ইউনূস
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:২৮
জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখায় বিশ্বের শীর্ষ ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকা স্থান পেয়েছেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। একইসাথে তাঁকে জাতিগঠনের কারিগর হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিপ্লবী অর্থনীতিবিদ থেকে বাংলাদেশের নেতা হয়ে ওঠা ডক্টর ইউনূসের জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো, যা তিনি দক্ষ হাতেই সামলাচ্ছেন।
২০২৪ সালে বিশ্ব বিজ্ঞানে নতুন রূপ দেয়া ১০ জনের এই তালিকা প্রকাশ করেছে লণ্ডনভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার। এই তালিকায় সেরাদের নির্বাচনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং চিকিৎসাসহ এই বছরের তালিকায় উঠে এসেছে আবহাওয়া পূর্বাভাসের নতুন ধারণা থেকে শুরু করে একটি জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি।
প্রতিবদেন ডক্টর ইউনূসের বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বৈরাচারী সরকারের পতনের বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতার চাহিদা অনুযায়ী এই অর্থনীতিবিদ দেশের হাল ধরেছেন। এটি ছিল ডক্টর ইউনূসের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যিনি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সাথে তা পালন করছেন।
সাময়িকীতে আরও বলা হয়, ডক্টর ইউনূস সেনাবাহিনী এবং ছাত্রজনতার সমর্থন নিয়ে দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন। দুর্নীতি নির্মূল, শিক্ষা, কর্মসংস্থানে সমতা প্রদান এবং যারা প্রতিবাদে শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা তার অন্যতম লক্ষ্য।
প্রতিবদেন বিভিন্ন বিশ্লেষকদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে তারা বলেছেন, ছয় দশকের পেশাজীবনে ডক্টর ইউনূস দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নতুন ধারণা পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান করা ইউনূসের কাজের মূল ভিত্তি। বয়সে আশির কোঠায় হলেও ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস শক্তিশালী মানসিকতার অধিকারী বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া ড. ইউনূস ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পরিবেশগত অর্থনীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নিকোলাস জর্জেসকু-রোগেনের অধীনে পড়াশোনা করেন। সে সময়ই তাঁর মধ্যে অর্থনীতি ও প্রকৃতির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে স্পষ্ট বোঝাপড়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন দেশ গঠনে অংশীদার হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন।
ড. ইউনূসের সবচেয়ে আলোচিত উদ্ভাবন হলো ‘মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ’, যার পরিমাণ প্রায়শই ১০০ ডলার বা তার চেয়ে কম হয়ে থাকে। ড. ইউনূস দেখিয়েছেন যে সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে, ক্ষুদ্রঋণ সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র অংশের জীবন বদলে দিতে পারে।
ড. ইউনূস ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে পরীক্ষা করতে শুরু করেন যে, ক্ষুদ্রঋণ কীভাবে ফেরত পাওয়া যায় এবং ঋণগ্রহীতারা কীভাবে এটি থেকে লাভবান হতে পারে।
এরপর তিনি একটি মডেল তৈরি করেন, যেখানে নারীদের ঋণ দেওয়া হতো তাঁদের ব্যবসা উন্নত করার জন্য। প্রথম পরীক্ষায় সব ঋণগ্রহীতাই তাঁদের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হন। ১৯৮৩ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। তবে অনেকে এর সমালোচনাও করেন।
তবে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা এবং ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ পরিচালনার মধ্যে ফারাক রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সবাই প্রশ্ন করছেন, ড. ইউনূস কি সত্যিই ছাত্রদের দাবির প্রতি যে প্রতিশ্রুতি তা রক্ষা করতে পারবেন? এসব দাবির মধ্যে—দুর্নীতি নির্মূল, নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমতা প্রদান এবং যারা প্রতিবাদে নিহত হয়েছেনতাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ মুশফিক মোবারক বলেন, ‘আগস্টের বিপ্লবের আগে দেশের পুলিশ, নাগরিক সেবা, বিচারব্যবস্থাসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি ব্যাংকগুলোও শাসক দলের শাখা হয়ে উঠেছিল। ইউনূস এবং ছাত্ররা—যারা অন্তর্র্বতী মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে আছেন—বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি করেছেন, যাতে যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পায়।’
কুমিল্লার বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্টের (বার্ড) গবেষণা পরিচালক ফৌজিয়া সুলতানা বলেন, ‘কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার তাড়াতাড়ি হতে পারে না। এটি একটি জটিল ও ধীরগতির প্রক্রিয়া।
অন্তর্র্বতী নেতা হিসেবে ড. ইউনূসের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে সেই সব ছাত্রের ওপর, যাঁরা তাঁকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা একটি শক্তিশালী দল, যাঁদের ভূমিকা ২০১০-২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামকারী যুবকদের মতো। সেই বিদ্রোহ সহিংসভাবে দমন করা হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গল্পটি ভিন্ন।
সেনাবাহিনী এবং ইউনূস উভয়েই ছাত্রদের সমর্থন করছেন। তবে এর মানে হলো—একটি বড় দায়িত্ব এক ব্যক্তির ওপর অর্পিত, যাকে অধিকার রক্ষা এবং সেই সব সুযোগ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে, যেগুলো ছাত্রদের অনেক বন্ধু ও সহকর্মী জীবিত থাকতে দেখতে পাননি।
শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আট শতাধিক মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হয়। এরপর ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশেষে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।