১০ মিনিটের উত্তাপে কীভাবে ট্রাম্প-জেলেনস্কির আলোচনা ভেঙে গিয়েছিল

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ২ মার্চ ২০২৫, ১৪:১৫

ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আশা করেছিলেন, শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে আলোচনা শেষ করতে পারবেন। তারপর সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে তিনি হোয়াইট হাউস ছাড়বেন।

শেষ পর্যন্ত তা হয়নি; বরং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সামনে খুব বাজেভাবে নাজেহাল হয়েছেন জেলেনস্কি। বৈঠক চলাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে তাঁর ব্যাপক বাগ্‌বিতণ্ডা হয়।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে জেলেনস্কির আরও বেশি করে কাজ করা উচিত বলে ট্রাম্প ও ভ্যান্স পরামর্শ দিলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট তাতে সায় দেননি। এতে ট্রাম্প ও ভ্যান্স ক্ষেপে গিয়ে বলেন, জেলেনস্কি তাঁদের অসম্মান করছেন।

একপর্যায়ে জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউস থেকে চলে যেতে বলা হয়। বৈঠক শেষে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির যৌথ সম্মেলন করার কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়। দুপক্ষের মধ্যে খনিজ সম্পদ চুক্তিটিও স্বাক্ষর হয়নি। জেলেনস্কি গাড়িতে করে হোয়াইট হাউস থেকে চলে যাওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হলে ফিরে আসবেন।’

উত্তপ্ত ওই বৈঠকে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত ছিল। এখানে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ চারটি মুহূর্ত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

জেলেনস্কি ও ভ্যান্সের মধ্যে উত্তেজনা

ওভাল অফিসে আলোচনাটা আন্তরিকভাবেই শুরু হয়েছিল। আধা ঘণ্টা ধরে এভাবেই চলেছে। এরপর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। জেডি ভ্যান্সের একটি কথার সূত্র ধরে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। জেডি ভ্যান্স বলেন, ‘কূটনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়াটাই হয়তো শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার পথ। আর সেটাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করছেন।’

জেলেনস্কি তখন কথা বলে ওঠেন। তিনি ২০১৯ সালে ব্যর্থ যুদ্ধবিরতি চুক্তিসহ তিন বছর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার পুরোদমে যুদ্ধ শুরুর কথা উল্লেখ করেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে জেলেনস্কি বলেন, ‘কেউ তাঁকে থামায়নি।’ জেলেনস্কি আরও বলেন, ‘আপনি কী ধরনের কূটনীতির কথা বলছেন জেডি? আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?’

ভ্যান্স তখন বলেন, তিনি সে ধরনের কূটনীতির কথা বলছেন, যা জেলেনস্কির দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে। এরপর দুপক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেন, জেলেনস্কি অসম্মানজনক আচরণ করছেন এবং মার্কিন গণমাধ্যমের সামনে পরিস্থিতিকে ঘোলা করছেন।

‘কী ভাবব না ভাবব, তা আপনারা ঠিক করে দেবেন না’

সামরিক বাহিনী ও বাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ভ্যান্স। জবাবে জেলেনস্কি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় প্রত্যেকেরই সমস্যা থাকে, এমনকি আপনাদেরও। কিন্তু আপনাদের কাছে একটা দারুণ সমুদ্র আছে। এখন এটা উপলব্ধি করতে পারবেন না, তবে আপনারা ভবিষ্যতে এটা বুঝতে পারবেন।’

এতক্ষণ পর্যন্ত বাগ্‌বিতণ্ডা জেলেনস্কি ও ভ্যান্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও জেলেনস্কির এ কথা শুনে ট্রাম্প ক্ষেপে যান। কারণ, ওই কথার মধ্য দিয়ে জেলেনস্কি বোঝাতে চাচ্ছিলেন, যুদ্ধের আক্রমণকারী পক্ষকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে নৈতিক ঝামেলাগুলো ট্রাম্প বুঝতে পারছেন না।

সমালোচকেরা বলে থাকেন, রাশিয়াকে নিয়ে ট্রাম্প ভুল হিসাব–নিকাশ করেছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করে তিনি পুতিনকেই শক্তিশালী করে তোলার মতো ঝুঁকি নিচ্ছেন। সমালোচকদের মতে, ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপ ইউরোপকে দুর্বল করে দেবে এবং ইউক্রেন দখল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। আর সেই বার্তাগুলোই হয়তো দিতে চেয়েছেন জেলেনস্কি।

ট্রাম্প এ যুদ্ধকে দুই পক্ষের মধ্যকার একধরনের বাইনারি দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন। তিনি মনে করেন, এ যুদ্ধের দায় দুপক্ষেরই আছে।

তবে জেলেনস্কি এ ধরনের চিন্তাভাবনার পরিণাম বিপজ্জনক হতে পারে বলে সতর্ক করার চেষ্টা করেন। ওভাল অফিসের ওই আলোচনায় জেলেনস্কি সরাসরি ট্রাম্পকে বলেন, ‘রাশিয়াকে শান্ত করুন, তখন যুদ্ধ আপনার হাতে চলে আসবে।’

এতে ট্রাম্প আরও বেশি ক্ষেপে যান। উচ্চ স্বরে তিনি বলেন, ‘আমরা কী ভাবব না ভাবব, তা নিয়ে আমাদের বলতে আসবেন না। সেটা বলার মতো অবস্থানে আপনি নেই।’ ট্রাম্প আরও বলেন, জেলেনস্কি লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছেন।

ট্রাম্প বললেন, ‘আপনারা একা ছিলেন না’

ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের একপর্যায়ে জেলেনস্কি বলেন, ‘যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকে আমরা একা ছিলাম এবং আমরা কৃতজ্ঞ।’ এ কথায় ক্ষেপে যান ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘আপনারা একা ছিলেন না। আমরা এ স্টুপিড প্রেসিডেন্টের (সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন) মাধ্যমে আপনাদের ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার দিয়েছি।’

এরপর ভ্যান্স অভিযোগ করেন, গত বছর মার্কিন নির্বাচনের সময় জেলেনস্কি ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে পেনসিলভানিয়ায় বাইডেনের নিজ শহর স্ক্রান্টনে জেলেনস্কির একটি যুদ্ধাস্ত্র কারখানা পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করেন ভ্যান্স।

ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান সদস্যরা জেলেনস্কির এই সফরে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা অভিযোগ করেছিলেন, এ সফরের মধ্য দিয়ে জেলেনস্কি আসলে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যটিতে কমলা হ্যারিসের পক্ষে প্রচারে অংশ নিয়েছেন।

ওভাল অফিসে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যকার আলোচনায় একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির তিক্ত বিভাজনগুলো প্রতিফলিত হতে থাকে। ভ্যান্স জানতে চান, বৈঠক চলাকালে জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ দিয়েছেন কি না।

জেলেনস্কি বলতে থাকেন, ‘দয়া করে, আপনি যদি মনে করেন যে আপনি যুদ্ধের বিষয়ে খুব উচ্চ স্বরে কথা বলবেন...,’ এ পর্যায়ে জেলেনস্কিকে থামিয়ে দেন ট্রাম্প। বিরক্ত চেহারা নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘তিনি উচ্চ স্বরে কথা বলছেন না। আপনার দেশ বড় সমস্যায় পড়েছে। আপনি জিতছেন না, আপনি এটা জিততে পারছেন না। আমাদের কারণে এখান থেকে আপনার ভালোভাবে বের হয়ে আসার সুযোগ আছে।’

জেলেনস্কিকে ভর্ৎসনা

ট্রাম্প আরও বলেন, ‘এভাবে কাজ করাটা খুব কঠিন। এ চুক্তি করাটা কঠিন কাজ হয়ে পড়ছে। কারণ, মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট দুজনই জেলেনস্কিকে ভর্ৎসনা করেন। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছিল, দুজনই জেলেনস্কির আচরণে ক্ষুব্ধ। ভ্যান্স একপর্যায়ে দাবি করে বলেন, ‘শুধু ধন্যবাদটুকু দিন।’

মূল ক্যামেরায় ধারণ হওয়া দৃশ্যের বাইরেও ওই কক্ষে আরেকটি দৃশ্য ছিল। আর এ দৃশ্যের চরিত্রটি হলেন ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওকসানা মার্কারোভা। ট্রাম্প ও ভ্যান্সের সঙ্গে জেলেনস্কির বাগ্‌বিতণ্ডা চলার সময় ওকসানাকে দেখা গেছে তাঁর দুই হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে রেখেছেন।

ওভাল অফিসের এ ঘটনার মধ্য দিয়ে জেলেনস্কির কূটনৈতিক অবস্থান এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তাকারী ক্ষমতাধর দেশের সঙ্গে তাঁর বর্তমান সম্পর্কের চিত্র ফুটে উঠেছে।

বলা যায়, শুক্রবার ট্রাম্পের কাছে তিনি যেভাবে নাজেহাল হয়েছেন, তা মূলত পুতিনের কাছে হেরে যাওয়ারই শামিল। প্রথম আলোর খবর, বিবিসি




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top