ঈশ্বরদীতে পদ্মা নদী ভরাট করে ৬ রাস্তা
ঈশ্বরদী থেকে | প্রকাশিত: ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ০৫:৫৪
সরকারি নিয়মনীতি না মেনে পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষা ঈশ্বরদীর ইটভাটা অঞ্চলখ্যাত লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে ৫২টি ইটভাটা, যার মধ্যে অধিকাংশেরই নেই অনুমোদন। আর অবৈধ এসব ইটভাটায় চরের খাসজমি ও নদীর পাড় থেকে লুট করা মাটি সহজে আনার জন্য পদ্মার বুকে ইট, সুরকি ও বালি দিয়ে মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে অন্তত ছয়টি সড়ক। যেসব সড়ক দিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চলছে মাটিবোঝাই ১০ চাকার ড্রামট্রাক ও ভারী ট্রাক্টর। এসব সড়কের কারণে পরিবর্তন হচ্ছে পদ্মার গতিপথ। শুকিয়ে গেছে নদী, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। এছাড়া রাস্তা নির্মাণের কারণে স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ায় দেশের অন্যতম প্রধান এ নদীর জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আগের মতো আর মাছ পাচ্ছেন না স্থানীয় মৎস্যজীবীরা।
এদিকে মাসখানেক আগে ইটভাটা মালিকরা প্রকাশ্যেই নদীর বুকে এসব সড়ক বানানোর কাজ শেষ করলেও তা রোধে তখন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ঈশ্বরদী উপজেলা বা পাবনা জেলা প্রশাসন। এমনকি মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত রাস্তাগুলো উচ্ছেদে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের।
অবশ্য ইটভাটা মালিকদের দাবি, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় থানা ও ফাঁড়ি, নৌ-পুলিশ, কতিপয় সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদকে ‘ম্যানেজ’ করেই ভাটা চালাচ্ছেন তারা।
গত সোমবার লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের কৈকুন্ডা, বিলকেদা ও কামালপুর এলাকায় গিয়ে পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা দেখতে পান এ প্রতিবেদক। সেখানে কৈকুন্ডা, বিলকেদা, শাহপাড়া, ডিগ্রিরচর, চরমাদিরারচর ও শানিকদিয়াড় চরের সরকারি খাসজমি ও পদ্মা নদীর পাড় কেটে মাটি লুট করে ইটভাটায় আনতে দেখা যায় ইটভাটামালিক এবং ক্ষমতাসীন দলের ‘মাটিচোর’ চক্রের সদস্যদের নিয়োগ করা শ্রমিকদের। বর্ষায় পদ্মা নদীর এ অংশটি বেগবান থাকলেও শীতে হাঁটুসমান পানি থাকে। আর পানি কমে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে ইটভাটায় মাটি নেওয়ার জন্য নদীর বুক চিরে আধভাঙা ইট, সুরকি ও বালি দিয়ে প্রায় ২০ ফুট চওড়া রাস্তা বানিয়েছেন ইটভাটামালিকরা। নদীর পানি প্রবাহের জন্য প্রতিটি রাস্তার নিচে বসানো হয়েছে চোং (কংক্রিটের মোটা পাইপ)। সেখানে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ছয়টি সড়ক তৈরি করায় নদীটি যেন পাড় বাঁধা ১০টি পুকুরে পরিণত হয়েছে। এসব রাস্তা দিয়ে ১০ চাকার ড্রামট্রাক ও ভারী ট্রাক্টরসহ মাটি পরিবহনের অর্ধশতাধিক যানবাহন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলাচল করছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
সোমবার সকালে সেখানে পদ্মা নদীর পাড় এবং চরের ফসলি জমিতে থাকা খেসারি, মসনি ও গমসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট করে এক্সকেভেটর দিয়ে সমানে মাটি কাটতে দেখা যায়। সেই মাটি ড্রামট্রাক ও ট্রাক্টরে ভরে নেওয়া হচ্ছিল ইটভাটায়। এ প্রতিবেদকসহ কয়েকজন সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে এক্সকেভেটর, ড্রামট্রাক ও ট্রাক্টরের চালকরা প্রথমে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পরে ইটভাটার মালিক ও ‘মাটিচোর’ চক্রের সদস্যরা এসে সাংবাদিকদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নেই ইটভাটা নির্মাণে সরকারি নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছে ৫২টি ইটভাটা। তবে চলতি ইট উৎপাদন মৌসুমে এবার এই ইউনিয়নে ৩৮টি ভাটা চালু রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হাওয়া ভাটা ও ৩৫টি চিমনি ভাটা। দুটি হাওয়া ভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকলেও বাকি ৩৬টি ভাটারই নেই কোনো অনুমোদন। যে কারণে প্রতি বছরই মৌসুমের শেষ দিকে পাবনার জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ভাটাগুলোতে অভিযান চালিয়ে নামমাত্র জরিমানা ও ভাঙচুর করা হয়। তবে এবার মৌসুম শেষের দিকে চলে এলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এবার এই ৩৮টি ইটভাটার জন্য ১৭টি এক্সকেভেটর দিয়ে পদ্মা নদীর পাড় ও ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে।
কয়েকটি ইটভাটার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এবার ইটের মৌসুম ভালো যাচ্ছে। তাই জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় থানা ও ফাঁড়ি, লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ-পুলিশ থানা, স্থানীয় কিছু সাংবাদিক এবং লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদকে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেই ভাটা চালানো হচ্ছে। আর পদ্মা নদী থেকে মাটি কাটার বিষয়টিও প্রশাসনের অবগতিতেই হচ্ছে।
এনএফ৭১/এমএ/২০২২
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।