শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রনো-মেনন জুটি ভেঙেছিল যে কারণে

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৪, ১৮:১৩

ভারতের প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গে হায়দার আকবর খান রনো (বাম থেকে দ্বিতীয়), রাশেদ খান মেনন (সবার বামে) ও অমল সেন (সবার ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি না ফেরার দেশে চলে গেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ‘৭০ সালে তৎকালীন স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার প্রবক্তা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক পলিটব্যুরোর সদস্য, কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা কমরেড হায়দার আকবর খান রনো। রাজনীতি ছাড়াও নিজের প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ইতিহাস নিয়ে রচিত তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে। অংশ নিয়েছিলেন ১৯৬২ সালের শরীফ কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলনে। অন্যদিকে, বাম আন্দোলনের আরেক বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন। কমরেড রনোর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রাজনৈতিক সহযোদ্ধা কমরেড মেনন। তাদের নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে একটি গণমাধ্যম ( সকাল সন্ধ্যা)। তারা শিরোনাম করেছে- রনো-মেনন জুটি ভেঙেছিল যে কারণে। লেখাটি নিউজফ্ল্যাশের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

ছাত্র আন্দোলন থেকেই রাশেদ খান মেননের সঙ্গে বন্ধুত্ব; এরপর কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভাজনে চীনপন্থি পতাকা ওড়ানোর সময়ও তাকে সঙ্গে নিয়েই ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো।

ছাত্র আন্দোলনের রনো-মেনন জুটি ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনের সময়ও ছিল নেতৃত্বে। তাদের অর্ধশতকের রাজনৈতিক সম্পর্কে ছেদ ঘটে দেড় দশক আগে। ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে প্রথমে নতুন একটি দল গড়েন রনো, পরে যোগ দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবিতে।

এই সিপিবির উপদেষ্টা পদে থাকা অবস্থায় ৮১ বছর বয়সে শনিবার পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন রনো। পাকিস্তান আমলে এই দলটিকে মস্কোপন্থি সুবিধাবাদী আখ্যায়িত করে আলাদা হয়েছিলেন রনোরা।

গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার পর শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন রনো। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছিলেন।

১৯৬৯ সালে চীনপন্থি রাজনৈতিকদের নিয়ে রনোসহ আরও কয়েকজন মিলে গঠন করেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও যোগ দেন তারা।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠন করে তার নেতৃত্ব দেন রনো। ১৯৭৯ সালে দলটির নাম পরিবর্তন করা রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। প্রথম থেকেই দলের পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন রনো। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

১৯৯২ সালে ওয়ার্কার্স পাটিতে যুক্ত হয় ইউনাইডেট কমিউনিস্ট লীগ ও সাম্যবাদী দল (আব্বাস)। নাম ওয়ার্কার্স পার্টিই থাকে। অমল সেন হন সভাপতি, রনো সাধারণ সম্পাদক। তার তিন বছরের মাথায় টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি অংশ দলত্যাগ করে।

এরপর ২০০৪ সালে দলের পলিটব্যুরোর সদস্য সাইফুল হকের নেতৃত্বে আরেকটি অংশ বেরিয়ে যায় এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে। তখনও রনো-মেনন একসঙ্গেই ছিলেন। ওয়ার্কার্স পার্টিতে রনো সভাপতির দায়িত্ব পালনের সময় মেনন ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

বামপন্থি দল ওয়ার্কার্স পার্টির ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচনে যাওয়ার পর তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০০৯ সালে রনোর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টির আলাদা কমিটি গঠন হয়। তারা দলের নাম দেয় ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠিত)।

তখন গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলা হয়েছিল, “পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শীর্ষ তিন নেতা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। একই সঙ্গে তারা পার্টিকে মহাজোটের মধ্যে বিলীন করে দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এভাবে তারা দলের নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে বুর্জোয়াদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

“নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার কারণে তারা আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের অধীনে থাকবেন। কোনও স্বাধীন ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবেন না। এছাড়া পার্টির সুবিধাবাদী নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।”

এতে মেননের নেতৃত্বের অধীনে ‘শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি’ আর চলতে পারে না বলে বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়। তখন রনো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “দলের বর্তমান নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং কমিউনিস্ট চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। তাই এ নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে পার্টিকে পুনর্গঠিত করলাম।”

অভিযোগ তুলে তাদের চলে যাওয়া নিয়ে মেনন তখন সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “রনো বিষয়টা ঠিক বলছেন না। ২০০৬ সালে যখন নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, তখন রনোই ছিলেন পাইওনিয়ার। ২০০৮ সালে সিদ্ধান্ত ছিল, আহূত হলে আমরা সরকারে যাব।”

রনোর সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব অটুট থাকার কথা জানিয়ে মেনন বলেছিলেন, তার চিন্তার পরিবর্তন ঘটে ওয়ান-ইলেভেনের সময়। কেন করলেন, তা আজও জানি না। শেখ হাসিনার সরকারের মাঝপথে ২০১৩ সালে ডাক পেয়েও দলের আপত্তিতে মন্ত্রী হতে পারেননি মেনন। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনা যে নির্বাচনকালীন সরকার গড়েছিলেন, তাতে যোগ দেন তিনি। পরে নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্বও নেন তিনি। এবারও নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য তিনি।

এদিকে রনো ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা কয়েকজনকে নিয়ে ২০০৯ সালে সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে দলটির সভাপতিমণ্ডরীর সদস্য হন তিনি। শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পর সিপিবির গত কংগ্রেসে তাকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে রাখা হয়।

শনিবার ঢাকার পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রনোর মৃত্যু হলে সেখানে ছুটি গিয়েছিলেন মেনন, রাজনীতিতে দীর্ঘ পথচলার সঙ্গীকে হারানোর শোক ছিল তার চোখে-মুখে।

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top