’শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুর পরিচিত’

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০২৫, ১৫:৪০

ছবি: সংগৃহীত

মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশুটি নিপীড়নের শিকার হয়েছিল বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে। বোনের স্বামীর সহায়তায় তার বাবা (বোনের শ্বশুর) মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই ঘটনার এক সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি অন্তত তিনটি শিশুর ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ ধর্ষণের শিকার শিশুর প্রতিবেশী, আবার কেউ নিকটাত্মীয়।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আট জনে একজন নারী ১৮ বছর বয়স হবার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮ টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। আর সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন।

গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচিতদের দ্বারাই শিশুরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়। নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা অধিকার কর্মীরা বলছেন, মূলত নিকটাত্মীয়ের প্রতি যে বিশ্বাস থাকে, তা ব্যবহার করেই এই ধরনের কাজগুলো করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং আইনের প্রয়োগ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেও সতর্ক করছেন তারা।

পরিচিতদের দ্বারাই ধর্ষণের শিকার বেশিরভাগ শিশু

যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ১০০টি যৌন নির্যাতনের ঘটনার ৯৩টির ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ভুক্তভোগী শিশুর পরিচিত কেউ থাকে, বলছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আরএআইএনএন। এ প্রতিষ্ঠানটি ধর্ষণ, সহিংসতা নিয়ে কাজ করে থাকে। এর মধ্যে পরিবারের সদস্য থাকে ৩৪ শতাংশ আর পরিচিত থাকে ৫৯ শতাংশ।

এই দৃশ্যের খুব একটা হেরফের দেখা যাচ্ছে না বাংলাদেশেও। দেশটির জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি নিবন্ধ অনুযায়ী, “শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুর পরিচিত হয়ৃৃতার আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ।”

শিশুদের ওপর হওয়া যৌন নিপীড়ন নিয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘চাইল্ড সেক্সুয়াল এবিউজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাতেও বলা হয়েছে, দুর্বৃত্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর পরিচিত কেউ থাকেন।

নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে শিশুদের নির্যাতনের শিকার হবার বিষয়টি ‘নতুন কিছু না’ হিসেবে উল্লেখ করে অধিকারকর্মী শাশ্বতী বিপ্লব বলেন, “এটা সবসময় শিশুদের জীবনের বাস্তবতা”।

“কাকা-মামা এরকম যারা আছে, তাদের কাছেইতো আমরা তাদের (শিশুদের) দেই বা তারা তাদের কাছে যায়। কারণ তারা মনে করে এরা আপন লোক, পরিবারের লোক। সেই সুযোগটাই যখন একজন পেডোফাইল (শিশুকামী) পায়, সম্পর্ক যাই হোক না কেন – সে এটাকে ম্যানিপুলেট করে”, বলেন শাশ্বতী বিপ্লব।

এনিয়ে আরেক অধিকারকর্মী নিশাত সুলতানা বিবিসি বাংলাকে বলেন, কিছু মানুষ তার অবদমিত ইচ্ছা পূরণের জন্য সহজ রাস্তা খোঁজেন। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ উপায় থাকে পরিবারের শিশুরা।

তিনি বলেন, “বাইরের মানুষের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের প্রিকশন (সতর্কতামূলক ব্যবস্থা) নেওয়া হয়। কোথায় যাচ্ছে? কার সাথে যাচ্ছে? কিন্তু মামা, চাচাদের ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলো করা হয় না। এই পরিজনদের সবাই বিশ্বাস করে, ফলে তারা সহজে এক্সেস পায়”। আর এই সহজ এক্সেসকেই ব্যবহার করে “বিশ্বাসের জায়গাটা এক্সপ্লয়েট করে তারা শিশুদের যৌন হয়রানি” করেন বলে মন্তব্য করেন মিজ সুলতানা।

ধর্ষণের শিকার ছেলে শিশুরাও

“আমাদের আইনে ছেলে শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলা নাই। এবং (বাংলাদেশের) আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ছেলে শিশুরা যে ধর্ষণের শিকার হতে পারে, এই ধারণাটাই স্বীকার করে না”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা।

বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২৪ সালেই ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি, আর ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে তিনটি।

আর ইউনিসেফ বলছে, সারা বিশ্বে হিসেব করলে এই সংখ্যা ২৪ থেকে ৩১ কোটি, অর্থাৎ প্রতি ১১ জনে একটি ছেলে শিশু শৈশবে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, বলছিলেন এই খাত নিয়ে কাজ করা একাধিক অধিকারকর্মী।

ছেলে শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই এনিয়ে সচেতনতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলেই মনে করেন শাশ্বতী বিপ্লব।

এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে কমিটি করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও সেটার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। অধিকারকর্মীরা বলছেন, নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করতে পারলে, এই ধরনের ঘটনা কমে আসবে।

কী কারণে শিশু ধর্ষণ?

বিচারহীনতার সংস্কৃতি সবসময়ই বাংলাদেশে দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘খুবই খারাপ’ অবস্থা এবং কোনো ধরনের জবাবদিহিতা না থাকার কারণে শিশুদের সঙ্গে হওয়া যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন অধিকারকর্মী শাশ্বতী বিপ্লব।

তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যে আসলে প্রচুর পেডোফাইল(শিশুকামী) আছে। ল এন্ড অর্ডার না থাকায় একটা কডিউসিভ এনভেরনমেন্ট (সহায়ক পরিস্থিতি) তৈরি হয়েছে চারদিকে যে - আমি যা খুশি করতে পারি”। আর এটি দুর্বৃত্তদের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে বলেই মনে করছেন মিজ বিপ্লব।

২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটনের শিশুদের ওপর হওয়া যৌন সহিংতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে শিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হবার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে।

যেমন, শিশুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নির্যাতনকারীর যৌনতৃপ্তি লাভ কিংবা নিজেকে নিয়ে পৌরুষযাচিত চিন্তা এক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও শিশুর বাহ্যিক সৌন্দর্যকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, সে বিষয়টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

একই কথা বলা হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেও। “দারিদ্র্যতার কারণে মা হয়তো বাসার বাইরে কাজ করতে চলে গেলো, বাচ্চাকে বাসায় রেখে যেতে হলো- এরকম ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা ঘটে”, বলেন অধ্যাপক হুদা।

তিনি বলেন, “আর দারিদ্র্যতার জন্য নিরাপত্তার অভাবও থাকে।” এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, বৈরি মনোভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্বসহ আরও কিছু বিষয়কে শিশু ধর্ষণের কারণ হিসেবে গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

যৌন নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা

অধিকারকর্মীরা বলছেন, শিশুদের যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। অপরাধীরা যে কয়টি কারণে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে, তার বড় একটি কারণ হলো সাজার ভয়, বলছিলেন মিজ বিপ্লব।

তিনি বলেন, “একসময় বাংলাদেশে এসিড সহিংসতা অনেক বেশি ছিল। সরকার তৎপর হবার পর তা কমেছে। একইভাবে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করে শাস্তির কিছু উদাহরণ তৈরি করা হয়, এটাও কমবে”। তবে কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করেই শিশুদের সঙ্গে হওয়া যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন এই অধিকারকর্মী। কারণ অনেক ঘটনাই পুলিশ পর্যন্ত আসে না।

সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের দিক থেকে সচেতনতা এবং নজরদারি বাড়ানো এবং শিশুদের এ বিষয়ে শেখানো প্রয়োজন। বিশেষ করে, অভিভাবকদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় তারা সন্তানদেরও সচেতন করতে পারছেন না। যার ফলে ভুগতে হচ্ছে শিশুদের। অনেক সময় তারা বুঝতেই পারে না যে তাদের সঙ্গে কী ঘটছে, ফলে এই ঘটনাগুলোকে আলাদা করে বাবা-মা’কে বলতে পারে না শিশুরা।

অধিকারকর্মীরা বলছেন, সেক্ষেত্রে সবার আগে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে বাবা-মায়ের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেবল ঘরের বাইরের বা অপরিচিতদের ক্ষেত্রেই না, পরিচিত-নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।

একইসঙ্গে শিশুদের যৌন শিক্ষা দেওয়া এবং কোন ধরনের স্পর্শ ভালো আর কোনটা খারাপ- এবিষয়ে সচেতন করার মতো বিষয়গুলোও পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করা জরুরি।

তবে অধিকারকর্মী মিজ সুলতানা বলেন, “পাঠ্যক্রমে আমাদের এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো এবং সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে যে বিষয়গুলো সহজে নিতে পারছে না। এমনও হয়েছে যে পাতাগুলো স্টাপলার করে রাখা হয়েছে।” ফলে সচেতনতা যেমন তৈরি হয়নি, তেমনি বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরাও। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পরামর্শ দিচ্ছেন অধিকারকর্মীরা। সূত্র: বিবিসি বাংলা




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top