চব্বিশের গণআন্দোলনে ঝড় তুলেছিল যেসব গান
সংগীত কেবল বিনোদনের বিষয় নয়, কখনও আগ্নেয়াস্ত্র হয়েও কাজ করে
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:৪৯
বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে গোড়া থেকেই জড়িয়ে আছে সঙ্গীত শক্তি। যা আমাদের শিকড়কে চেনায়, তুলে ধরে জীবনের অর্থ। খুঁজে দেয় মুক্তির পথ। মুক্তিকামী মানুষের হাতকে যোদ্ধার শাণিত হাতে মিলিয়ে দিতে অনেকেই গেয়েছেন প্রতিবাদের গান। যার মাধ্যমে সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগ্রত করা যায়।
যেকোন উৎপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ একসময় দাঁড়িয়ে যায়। সময়ের চাতালে সব আক্রোশ, সব না পাওয়া, সব অক্ষমতা জড়ো হয়। আর শিল্পীরা তা দিয়ে গেঁথে চলেন সব দ্রোহগান। বজ্রপাতের ঝলকানিতে চমকে ওঠা সমবেত স্পর্ধার ঘটনা বুনে চলেন নতুন দিনের আশ্বাসে।
তেভাগা থেকে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। গণমানুষ বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন। কেউ সাহস দিয়ে আবার কেউ গানের মাধ্যমে ঝড় তুলেছেন। গানের বাণী যখন চিরন্তন হয়, তখন সেটি কালের সীমানা জয় করে।
এক সময় দেশের গান আর গণসঙ্গীতই ছিল ভরসা। এবার ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে উন্মাদনা ছড়িয়েছে বাংলা র্যাপ গান। পাশাপাশি সঙ্গ দিয়েছে ব্যান্ডসংগীতও। এক সময় এসব মনে করা হতো বিজাতীয় সংস্কৃতি, এখন জীবনের অনুষঙ্গ। এবার যখন রাজপথে লড়ছিলেন শিক্ষার্থীরা। ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় অনেকে ছিলেন চুপ।
সেই অবরুদ্ধ সময়কে গানে ধরেছিলেন নারায়ণগঞ্জের তরুণ র্যাপার সেজান। ১৬ জুলাই প্রকাশ পায় সেজানের কথা ক। মুহূর্তেই স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে গানটি। আরেক র্যাপ গান আওয়াজ উডা নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। গানটি রীতিমতো স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। আলোচিত গানটি গেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আরেক তরুণ র্যাপার হান্নান হোসাইন। ১৭ জুলাই আওয়াজ উডা লিখেছেন হান্নান। সেদিন গানটি শ্রোতামনে অগ্নিঝড় তোলে।
আন্দোলনের মধ্যে অন্তত ৪০টি বাংলা র্যাপ গান প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি র্যাপ গান আন্দোলনে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। আন্দোলনের মধ্যে প্রকাশিত র্যাপ গানের মধ্যে আরও রয়েছে দেশ সংস্কার, স্বাধীনতার গন্ধ, ছাত্র, অধিকার, দেশ কারও বাপের না, জয় বাংলা, কত খাবি, শকুনের চোখ। এর মধ্যে কথা ক, বাংলা মার মতো গান শুনলে রক্তে আগুন লেগে যায়। সোহেল আরমানের লেখা এবং হাবীব ওয়াহিদ, আরফিন রুমি ও প্রদীপ কুমারের গাওয়া হৃদয় আমার বাংলাদেশ, ইথুন বাবুর লেখা ও মৌসুমীর গাওয়া দেশটা তোমার বাপের নাকি আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরব ছিলেন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। আন্দোলনের মধ্যে ভয় বাংলায় শিরোনামে একটি গানও এনেছেন তিনি। আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের উৎসর্গ করে অনি হাসান প্রকাশ করেছেন আমরা বীর। শহরতলী ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সোহাগ গেয়েছেন ‘ও প্রধান। তরুণ গায়িকা পারশা মাহজাবীনের ‘চলো ভুলে যাই ঝড় তুলেছিল।
প্রিন্স মাহমুদের কথায় জেমসের গাওয়া বাংলাদেশ, শিল্পী হায়দার হোসেনের স্বাধীনতা, শূন্য ব্যান্ডের শোনো মহাজনসহ আরও কয়েকটি গান আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে। অনিক সূত্রধরের ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’ ও ‘বাজান আমার হয়ে গেছে লাশ’, র্যাপার সেজানের ‘কথা ক’, ‘চব্বিশের গেরিলা’, আন্দোলনের বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
কোল্ডক্রাফটের বায়ান্ন, অ্যাজ অমিক্সে ‘রক্ত, ম্যাক-ই-ম্যাক ও জিকে কিবরিয়ার স্লোগান ও ইনকিলাব, সিয়াম ফারদিনের আবু সাঈদ, নাহিদ হাসানের জবাব দেনা, রেভ্যুলেশন ইন মোশনের পাল্টে দে ইতিহাস, ভয়েস অব রেভ্যুলেশনের রাজাকার, লুনাটিক্স বীর ও রিদমাস্ত্রের দেশ কারসহ আরও কয়েকটি গান এখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বড় অস্ত্র হয়ে উঠে। এখানেই শেষ নয়। দেশের প্রথম সারির ব্যান্ড মাকসুদ ও ঢাকার আবার যুদ্ধে যেতে হবে, আর্কের আর কত মৃত্যু, ওয়ারফেজের জনস্রোত’ গানগুলো প্রতিবাদী জনতার মাঝে নতুন সাড়া ফেলে।
ইতিহাসের পটপরিবর্তনে গান বুলেট, বোমার মতোই বড় এক হাতিয়ার। সংগীতের এক আলাদা শক্তি রয়েছে। সংগীত প্রাণকে উজ্জীবিত করে। প্রশান্তি এনে দেয়। অনেক সময় চেতনাকে শাণিত করে। কাল থেকে কালান্তরে সংগীতের সুধায় আচ্ছন্ন হয় মানুষ। গানের শক্তি তো এমনই হয়। এক নিমেষেই ছড়িয়ে পড়তে পারে সকল বাধার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে। সঙ্গীত শক্তি সব অপশক্তিকে পরাজিত করে শান্তিধারা বইয়ে দিতে পারে। সঙ্গীতই পারে জাতিকে আবার ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে।
কিন্তু শঙ্কাও আছে। অপশক্তি দেশকে পেছনে নিতে চায়। তারা বিভাজনের রাজনীতি জিইয়ে রাখতে চায়। সংবিধান আক্রান্ত হয় যখন তখন। ক্ষত হয় জাতীয় সংগীত। রাষ্ট্রযন্ত্রে ইতিহাস জিম্মি হয়। অপপ্রচারের কারখানা তৈরি হয়। চলে দীর্ঘ মেয়াদী ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা। দেশ সংস্কার চলছে, এটা মন্দ নয়। কিন্তু আমাদের মনন মগজের সংস্কার কতদূর। যে যায় লঙ্কায়, সে রাবণ। অথবা ভূতের মুখে রাম নাম। কিংবা সর্ষের মধ্যে ভূত। এসব দেখেশুনে আমরা অভ্যস্ত। ফলে আবারও ভুল হলে আমাদের ভয়ঙ্কর আগামী।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।